-->

সিভিল সার্জন কার্যালয়ে নিয়োগ দিতে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

আরিফুর রহমান
সিভিল সার্জন কার্যালয়ে নিয়োগ দিতে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্থানীয় এমপির সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা: শেখ সুফিয়ান রুস্তমকে পদাবনতী দিয়ে ভোলা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের সহকারী পরিচালক পদে বদলী করা হয়েছে। অপরদিকে একই অপরাধ করলেও মাগুরার সিভিল সাজন ডা. শামীম কবীরের বিরুদ্ধে কোন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে মাগুরাবাসী। গত ১৮ এপ্রিল ২০২৪ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এ আদেশ জারি করা হয়। যার স্মারক নং ৪৫.০০.০০০০.১৪৮.০০৫.২০২১.২১২।

আদেশে স্বাক্ষর করেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মঞ্জুরুল হাফিজ। উল্লেখ্য যে, তিনি সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন পদে থেকে ১২৫ জন কর্মচারী নিয়োগে চরম স্বেচ্ছাচারীতা প্রদর্শন করে নিয়োগ কার্যক্রম সমাপ্ত করেন। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হলে তাকে পদাবনতী দিয়ে ভোলা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে সহকারী পরিচালক পদে বদলী করা হয়। অপরদিকে একই ধরনের নিয়োগ কার্যক্রমে মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। ৭১ কর্মচারি নিয়োগ পরীক্ষায় ঘটেছে এই অস্বাভাবিক কান্ড।

দেখা গেছে এক রাতেই প্রায় ৬ হাজার লিখিত পরীক্ষার খাতা মুল্যায়ন করা হয়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি রিটেন পরীক্ষা নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফলাফল প্রকাশ করে ২৫ ফেব্রয়ারি ভাইভা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এ যেন রকেট গতির নিয়োগ পরীক্ষা। সিভিল সার্জন অফিসের প্রভাবশালী দুই কর্মচারির ৭/৮ জন শ্যালক, শালিকা, ভাগ্নে, ভাতিজা, বিয়াই, খালাত-মামাতো ভাইকে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করানো হয়েছে খাতার নাম্বার টেম্পারিং করে।

জানা গেছে, মাগুরা স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজস্ব খাতের আওতায় ১১-১৭ গ্রেডভুক্ত মোট ৬টি পদের বিপরীতে ৭১ জন জনবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ঘটেছে অলৌকিক ঘটনা। এক রাতে প্রায় ৬ হাজার খাতা মুল্যাযন করা হয়েছে। সিভিল সার্জন অফিসের দুইজন কর্মকর্তা ও কর্মচারি এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক বলে গুঞ্জন চলছে। তারা সিভিল সার্জন ও নিয়োগ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ম্যানেজ করে চাকুরী দেবার শর্তে কমপক্ষে ৫০ জন প্রার্থীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস নিয়েছেন মর্মে অভিযোগ উঠেছে। এখাতে তারা প্রায় ১০ কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে। এই টাকা নিয়োগ কমিটির সভাপতি, সদস্য সচিব ও অন্য ৩ সদস্যের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়েছে বলে গুঞ্জন চলছে।

একাধিক সুত্রে জানা গেছে, মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজস্ব খাতের আওতায় ১১-১৭ গ্রেডভুক্ত মোট ৬টি পদের বিপরীতে ৭১ জন জনবল নিয়োগের জন্যে গত ২৭ ডিসেন্বর ২০২৩ নিযোগ বিজ্ঞপিÍ প্রকাশ করা হয়। পদগুলো হলো- পরিসংখ্যানবিদ ৪ জন, কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান-১ জন, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষারক-৩ জন, স্টোর কিপার-৫ জন, স্বাস্থ্য সহকারী-৫৫ জন, গাড়ি চালক-৩ জন। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর মাগুরা জেলার প্রায় ৫০ হাজার প্রার্থী আবেদন করে। তাদের মধ্য থেকে লিখিত পরীক্ষার জন্য মোট ৮ হাজার প্রার্থীকে পত্র দেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষা গ্রহনের পর খাতা মূল্যায়ণ অন্তে গাড়ি চালক পদে ১৬ জন, স্বাস্থ্য সহকারী পদে ১২১ জন, কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান পদে মাত্র ১ জন, স্টোর কিপার পদে ১৯ জন, পরিসংখ্যনবিদ পদে ২২ জন অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষারক পদে ১৮ জনকে পাশ করানো হয়। সম্প্রতি, ভাইভা পরীক্ষা নেওয়ার সময় প্রক্সি পরীক্ষা দিতে এসে ৪ জন চাকরি ভুয়া প্রার্থী আটক হয়েছে। তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। আটক ৪ পরীক্ষার্থী হলো- মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের এসকে নুরুজ্জামানের ছেলে এসকে মনিরুজ্জামান, একই উপজেলার মন্ডলগাতি গ্রামের আলাউদ্দিন মন্ডলের ছেলে শরিফুল ইসলাম, নাগড়া গ্রামের জামাল মুন্সির ছেলে সজিব হোসাইন এবং সদর উপজেলার আমুড়িয়া গ্রামের ওয়াহাব আলির ছেলে মিরাজ হোসেন। তারা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রক্সি পরীক্ষা দিতে এসেছিল বলে জানা গেছে।

মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে রাজস্ব খাতের আওতায় ১১-১৭ গ্রেডভুক্ত মোট ৬টি পদের বিপরীতে ৭১ জন নিয়োগের জন্যে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে মাগুরা সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে আহবান জানানো হয়। সেখানে মৌখিক পরীক্ষা চলাকালে অভিযুক্ত ৪ প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার খাতা সমন্বয় করতে গেলে সামঞ্জস্যতা না পাওয়ায় তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। অভিযুক্তরা স্বাস্থ্য সহকারী পদের জন্যে আবেদন করলেও অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষায় তারা প্রক্সি পরীক্ষার্থী নিয়োগ করে। একেক জনের বিপরীতে ২ লাখ টাকা নিয়ে প্রক্সি পরীক্ষার্থীরা লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।

লিখিত পরীক্ষা শেষে প্রকাশিত ফলাফলে উত্তীর্ণ প্রার্থী হিসেবে অভিযুক্ত প্রার্থীদের নাম প্রকাশ হলে তারা মৌখিক পরীক্ষায় সশরীরে অংশ নিতে গেলে আটক হয়। তবে অভিযুক্ত চাকরিপ্রার্থীদের পক্ষে কারা লিখিত পরীক্ষায় কারা অংশ নিয়েছে সেটি সম্পর্কে সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়নি।

এ বিষয়ে মাগুরা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পিয়ার উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রক্সি পরীক্ষার্থী নিয়োগের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৪ জনকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা নং ৪৪ তাং ২৬/২/২০২৪ ইং।’

এ দিকে নানা মাধ্যমে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে. মাগুরা সিভিল সার্জন অফিসে জনবল নিয়োগ করার জন্য ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি হলেন, খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মুঞ্জুরুল মুরশিদ, সদস্য সচিব-মাগুরার সিভিল সার্জন ডা. শামীম কবীর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মানব সম্পদ বিভাগ (২) এর সিনিয়র সহকারী সচিব সুজিত দেব নাথ সদস্য, মাগুরা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি) মো. রোকনুজ্জামান সদস্য।

অভিযোগ উঠেছে যে, মাগুরা সিভিল সার্জন অফিসের একজন মেডিকেল অফিসার, একজন সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার, একজন জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসারসহ আরো ৬ জন কর্মচারি থাকলেও ২ জন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগ পক্রিয়ার সমস্ত কলকাঠি নাড়ছেন। তারা ২ জন সিভিল সার্জন ডা. শামীম কবীরের অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় ফাইলপত্র সংরক্ষন ও নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল ওয়ার্কের জন্য তাদেরকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী মো. ওলিয়ার রহমান হলেও তাকে কোনঠাসা করে রেখে নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ করানো হচ্ছে এই ২ জনকে দিয়ে। তারা হলেন- ক্যাশিয়ার আবুল কালাম আজাদ ও জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার মো. হায়াত হোসেন। তাদের বিরুদ্ধে লিখিত পরীক্ষার খাতার মার্ক টেম্পারিং করার জোরাল অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে যে, তাদের সাথে যে সব প্রার্থীর চুক্তি হয়েছে তাদের লিখিত পরীক্ষার খাতার মার্ক টেম্পারিং করে নম্বর বদলে কৃতকার্য করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, এই ২ কর্মকর্তা ও কর্মচারি সিভিল সার্জন ডা. শামীম কবীরের ডানহস্ত হয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের যাবতীয় কলকাঠি নেড়েছেন।

এ ক্ষেত্রে তারা দালাল নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন। তারা স্বাস্থ্য সহকারী পদের জন্য ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা,পরিসংখ্যনবিদ পদের জন্য ২০ লাখ টাকা, ড্রাইভার পদের জন্য ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা, অফিস সহকারী পদের জন্য ১০ থেকে ১৪ লাখ টাকা এবং স্টোর কীপার পদের জন্য ২০ লাখ টাকা নিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। যে সব প্রার্থী তাদের দাবী মত টাকা দিয়েছে তাদের চাকুরী হয়েছে। একাধিক সুত্রের দাবী, নিয়োগ কমিটির সভাপতি,সদস্য সচিব ও অন্যান্য সদস্যদের নামে এই টাকা নেওয়া হয়েছে। অপর দিকে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবদ্বন্দ্বী কোটায় একজন প্রার্থীও লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেনি যা যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। এছাড়া কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান পদে মাত্র একজন প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করানো হয়েছে। ফলে তার চাকুরী নিশ্চিত হয়েগেছে। ভাইভা পরীক্ষায় মাত্র একজন প্রার্থী থাকেলে সেই পদের নিয়োগ অবশ্যই বাতিল হওয়ার যোগ্য বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান পদে কেন মাত্র একজন পরীক্ষার্থীকেই পাশ করানো হলো তার কোন জবাব মেলেনি।

এ বিষয়ে নিয়োগ কমিটির সভাপতি খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মনঞ্জুরুলল মুরশিদ ও সদস্য সচিব মাগুরা সিভিল সার্জন ডা. শামীম কবীরের সাথে কথা বললে তারা এ প্রতিবেদককে জানান, ‘সর্ব্বোচ্য স্বচ্ছতার সাথে এই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। কোন প্রকান অনিয়ম-দুর্নীতি বা ঘুস লেনদেন হয়নি।’

ভোরের আকাশ/ইস

মন্তব্য

Beta version