একই পরিবারের একাধিক সদস্যের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে
নিখিল মানখিন
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫ ০৮:৩৫ এএম
প্রতীকী ছবি
দেশের অব্যাহত হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ধরনও দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। অভিন্ন ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি এমন ঘটনার হার বেড়েছে। প্রতি মাসেই একটি পরিবারের একাধিক সদস্যের খুন হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে খুন-খারাবির ঘটনা কম-বেশি সব দেশেই ঘটে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশে খুন করা এবং হত্যার শিকার হওয়ার ধরনও যেন পাল্টে যাচ্ছে।
গত ৩ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগরে মা ও দুই শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনায় ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুমিল্লায় নারী নির্যাতন করে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার প্রধান অভিযুক্ত শাহ পরানসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা র্যাব। গত ১৬ জুলাই বগুড়া সদরের হরিগাড়ী এলাকায় লাইলী খাতুন (৭০) ও তার ছেলের বৌ হাবিবা বেগমকে (২২) ছুরিকাঘাত করে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন লাইলীর ১৮ বছর বয়সী মেয়ে বন্যা আক্তার। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। নিহত লাইলী খাতুন জেলা সদরের হরিখালী ইসলামপুর এলাকার মৃত আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী এবং হাবিবা বেগম পারভেজ আলমের স্ত্রী। সংশ্লিষ্ট ছিলিমপুর মেডিকেল ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর হারুনুর রশিদ তথ্যগুলো নিশ্চিত করেছেন।
বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাসান বাসির জানান, ধারণা করা হচ্ছে, পূর্ববিরোধের সূত্র ধরে পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঝিনাইদহে হানিফ আলী ওরফে হানেফ, তার শ্যালক লিটন ও রাইসুল ইসলাম রাজু নামের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই রাতেই ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকা থেকে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে। পরে এই হত্যার দায় স্বীকার করে জাসদ গণবাহিনীর কালু নামে এক ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের খুদে বার্তা পাঠান। এঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে স্ত্রী ও শিশু সন্তানসহ তিনজনকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে মাটিচাপা দিয়ে গুম করেন ইয়াছিন আলী। চারদিন নিখোঁজ থাকার পর গত ১১ এপ্রিল দুপুরে ভাড়া বাসার সামনের রাস্তায় মাটি খুঁড়ে লামিয়া, স্বপ্না ও শিশু আব্দুল্লাহ খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত লামিয়া আক্তারের বড় বোন মুনমুন আক্তার (৩২) বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঝিনাইদহে হানিফ আলী ওরফে হানেফ, তার শ্যালক লিটন ও রাইসুল ইসলাম রাজু নামের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই রাতেই ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকা থেকে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে। পরে এই হত্যার দায় স্বীকার করে জাসদ গণবাহিনীর কালু নামে এক ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের খুদে বার্তা পাঠান। এঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এভাবে প্রতি মাসেই একাধিক এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে যেখানে নিহতের তালিকায় একই পরিবারের একাধিক স্বজনের নাম বেরিয়ে আসছে। হত্যাকাণ্ডের এমন লোমহর্ষকতা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
বাংলাদেশে অপরাধীদের বেপরোয়া এবং নৃশংস আচরণের পেছনে রাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে একটি অপরাধপ্রবণ সমাজের শিকড় আরো গভীরে যাবে বলে মনে করছেন তারা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে নিজেদের হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই নৃশংসতার পথ বেছে নেয় অপরাধীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এই ধরনের একটি প্রবণতা দেখছি। কারণ অনেক মব ভায়েলেন্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যারা মব করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা প্রশংসিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখিয়েছে। এখানে কোনো না কোনোভাবে নৃশংসতারও প্রশংসা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক বা অন্যকোনো কারণে যদি রেহাই পাওয়ার সুযোগ পায় তাহলে তারা আরো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত হয়। ফলে তারা আরো বড় অপরাধী হয়ে ওঠে।
তিনি আরও বলেন, ‘অভিন্ন ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি এমন ঘটনার হার বেড়েছে। প্রতি মাসেই একটি পরিবারের একাধিক সদস্যের খুন হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেশে খুন-খারাবির ঘটনা কম-বেশি সব দেশেই ঘটে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশে খুন করা এবং হত্যার শিকার হওয়ার ধরনও যেন পাল্টে যাচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘কিছু মানুষ আছে যারা অপরাধ প্রবণ। তাদের বলা হয় লাইকলি অফেন্ডার। তারা অপরাধের সুযোগ খোঁজে। তারা সুইটেবল টার্গেট খোঁজে। তারা কখন অপরাধ করলে সেটা এফেকটিভ হবে তা বিবেচনা করে। তারা দেখছে অপরাধ করলে তারা পার পাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর তৃতীয়ত হলো লিগ্যাল গার্ডিয়ানশিপ। মনিটরিং, সার্ভিলেন্স, বিচার এগুলো ঠিক মতো হচ্ছে না। অপরাধের ক্ষেত্রে টেকনিক অব নিউট্রালাইজেশন আছে।
এর পাঁচটি ভাগ আছে। ওই পাঁচটি বিষয় দূর করা না গেলে রাষ্ট্র ও সমাজে অপরাধ বাড়ে। প্রথম হচ্ছে দায় না নেওয়ার সংস্কৃতি। দ্বিতীয়ত, কেউ স্বীকার করতে চায় না যে তার কারণে এটা হয়েছে। কেউ দায় দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। আবার কেউ দায় দিচ্ছে রাজনৈতিক দলকে। তারা আবার অস্বীকার করছে। তৃতীয়ত, ডিনায়েল দ্য ইনজ্যুরি বলা হচ্ছে তার নিজের কারণেই সে হত্যার শিকার হয়েছে। সে নিজেও চাঁদাবাজ। চতুর্থত, কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। একটি রাজনৈতিক দল কথা বললে আরেকটি রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বলা হয় আপনি কথা বলার কে? সর্বশেষ, অ্যাপিল টু দ্য হায়ার লয়ালটি। তারা ওই নেতৃত্বকে খুশি করতে যেকোনো কাজ করে। আর নেতৃত্বও তাকে শেল্টার দেয়। এই পাঁচটিই আমাদের এখানে বিদ্যমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পরে রাষ্ট্র ও সমাজ যে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং আইনের শাসনের পথে হাঁটতে চায় সেই ব্যবস্থাগুলো আমরা দেখছি না। ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে। বিচার নিশ্চিত না করা গেলে এরকম হবে। এর সঙ্গে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা, আছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়- সবমিলিয়ে পরিস্থিতি এমন হচ্ছে। আর এখানে এখন প্রতিবাদ করলে মানুষ নিগ্রহের শিকার হয়, তার নিরপত্তা নাই। এই কারণে কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় মামলার সাক্ষীও হতে চায়না। একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। তারা আরো নৃশংস হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ধরন ও বীভৎস্যতা সাধারণ মানুষের ব্রেইনে আঘাত হানছে। একই পরিবারের একাধিক সদস্য একই ঘটনায় হত্যার শিকার হচ্ছে। এমন লোমহর্ষক ঘটনা বেড়েই চলেছে।’
ছয় মাসে বেড়েছে খুনের ঘটনা : চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে খুনের ঘটনা। জানুয়ারিতে সারা দেশে খুনের মামলা হয় ২৯৪টি, জুনে হয়েছে ৩৪৪টি। গত ছয় মাসে ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ ও পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার মতো ঘটনায় মামলা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের দেওয়া পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রেস উইং ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অপরাধের পরিসংখ্যান তুলে ধরে।
প্রেস উইংয়ের সরবরাহ করা অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে খুনের মামলা বেড়েই চলছে। জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ২৯৪টি। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয় ৩০০টি। এরপর মার্চে খুন ৩১৬টি, এপ্রিলে ৩৩৮টি, মে মাসে ৩৪১টি। আর গত জুনে খুনের মামলা ছিল ৩৪৪টি।
ভোরের আকাশ/এসএইচ