-->

মধ্যবিত্তের ঘাড়ে জোর করে চেপে বসেছে ‘ঈদ–বকশিশ’

নিজস্ব প্রতিবেদক
মধ্যবিত্তের ঘাড়ে জোর করে চেপে বসেছে ‘ঈদ–বকশিশ’

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদকে ঘিরে ‘বকশিশ’ নেওয়া এক প্রকার রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তবে মধ্যবিত্ত ও অল্প আয়ের মানুষের কাছে ‘ঈদ–বকশিশ’ এক রকম বিড়ম্বনা। আসন্ন ঈদুল ফিতর ঘিরে এমন বিড়ম্বনায় নীরব কষ্টের মধ্যে পড়েছেন তারা।

 

মূল্যস্ফীতির বাজারে যারা অল্প আয়ে কোনোরকম সংসারের হাল ধরে রেখেছেন তাদের ঘাড়ে জোর করে চেপে বসেছে ‘ঈদ–বকশিশ’। চেপে বসা এই সংস্কৃতি এখন নিয়মে পরিণত হওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়ে সাধ্যের বাইরে গিয়ে বকশিশ দিচ্ছেন মধ্যবিত্তরা।

 

এখানেই শেষ নয়—অল্প টাকা দিলে বকশিশ প্রত্যাশীদের অধিকাংশরাই নিতে চান না। মুখ ভার করে থাকেন। কর্মস্থলে বা বাসা-বাড়িতে শুনতে হয় অপমানসূচক কথা। অনেক সময় মুখোমুখি হতে হয় বুলিংয়ের। তাই বাধ্য হয়েই লোকলজ্জায় পড়ে দিতে হচ্ছে ‘ঈদ বকশিশ’

 

মামুন নামের একজন লিখেছেন, ঈদের সময় সেলুনে গেলে বকশিশ, রিকশায় উঠলে বকশিশ, বাসার দারোয়ানের বকশিশ, যিনি সিঁড়ি পরিষ্কার করেন তাকেও বকশিশ দিতে হয়। এমনকি ময়লার বিলের সঙ্গেও বকশিশ দিতে হচ্ছে। এগুলো দেওয়াটা যেন বাধ্যতামূলক। অথচ যে ছেলেটা ১৫ হাজার টাকা বেতন পায়, সে কিভাবে এগুলো হ্যান্ডেল করবে? তারও তো পরিবার আছে। আবার এমন যদি হয়, সে অফিস থেকে কোনো ঈদ বোনাস পেল না। তাহলে সে কিভাবে এত বকশিশ দেবে? এই বিষয়গুলো কে বুঝাবে?

 

অফিস থেকে শুরু করে রাস্তা ঘাটে সবাই বকশিশ চেয়ে বসেন। দিলে আবার অল্পতেও খুশি না। বিষয়টি নিয়ে নিয়ে প্রত্যেককে সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ করা প্রয়োজন একটি গ্রুপে দেওয়া এই পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় অনেকে জানিয়েছেন তাদেরও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

 

আফসানা মিম নামের একজন লিখেছেন, সিঁড়ি ক্লিন করতে এসে বকশিশ চাইলো। যে বকশিশ দেয় তার সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করে। আর না দিলে মুখের দিকে তাকানো যায় না। আবার বকশিশ না দিলে ঘরের সামনে ঠিক করে পরিষ্কারও করে না।

 

রায়হান নামের আরেকজন লিখেছেন, বিষয়গুলো খুবই বিরক্তিকর। বাসার দারোয়ানকে ঈদের বকশিশ না দিলে সে সবার সামনে অপমান করে।

 

১০০ টাকার নিচে বকশিশ দিলে নিতে চান না জানিয়ে তায়েবা তাসরিক রিমতি নামের আরেকজন লিখেছেন, গত ৩০ তারিখ ময়লার বিল নিয়ে আসছে। সঙ্গে বকশিসের আবদার। ময়লার বিল ১২০ টাকা আর ৩০ টাকা বকশিশ দিয়ে মোট ১৫০ টাকা দিয়েছি। যদিও তখনো বেতন পাইনি। সে বলেছে ৩০ টাকা কি বকশিস হয় নাকি? যার যেমন সাধ্য সে তো তেমনই দেবে। ব্যাপারটা আমার অনেক খারাপ লেগেছে।

 

বর্তমানে বকশিশ বাধ্যতামূলক দিতেই হয় উল্লেখ করে রাশেদ আহমদ নামের আরেকজন লিখেন, সেদিন পাঞ্জাবি ফিটিং করতে গেছি, ওখানে বকশিশ নিয়েছে। তারপর গতকাল সেলুনে গেছি, ওখানে বকশিশ নিয়েছে। এরপর বাড়িতে যাওয়ার সময় হিজড়া, রিকশা, বাস, সিএনজি, অটো সবজায়গায় ঈদ বকশিশ হিসেবে বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। এভাবে দিতে দিতেই টাকা শেষ। সবশেষে দেখা যায়, নিজের জন্য কিছু নেওয়ার টাকাই থাকে না। বর্তমান সময়ে বকশিশ যেন এক প্রকার অধিকার। যা বাধ্যতামূলক দিতেই হবে।

 

আবার ঈদ বকশিশ নিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরও। তারা বলছেন, একজন শিক্ষার্থী যখন ঈদের আগে মেস, হল বা হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি যায় তখন সেখানকার খালা, মামা, কর্মচারী, দারোয়ানকে বকশিশ দিতে হয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই টিউশনির বাইরে কোনো উপার্জন করেন না। তারা অভিভাবকের টাকায় চলেন। হাত খরচ থেকে বাঁচিয়ে যেটুকু সঞ্চয় করা যায় খুব শখ করে বাড়ি যাওয়ার আগে সেই টাকায় সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করা সম্ভব হয়। আবার এই সময়টাতে মামা-খালাদেরও বকশিশ দিতে হয়। তবে সমস্যা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের চাহিদা থাকে অনেক বেশি। সামর্থ্য অনুযায়ী খুশি হয়ে যা দেওয়া হয় সেটি তারা নিতে চান না। মন খারাপ করেন। বলেন, ৫০-১০০ টাকায় কি হয়। পারলে বাড়িয়ে দেন, না হলে দরকার নেই।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, টিউশন ছাড়া শিক্ষার্থীদের অন্যান্য উপার্জন করার সুযোগ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব কম। যারা আমাদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন তাদের আমরা যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। কিন্তু ঈদের সময় তাদের প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশি। এটি নিয়ে শিক্ষার্থীদেরও বেশ ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়। অনেকেই রয়েছেন যারা চাকরি প্রত্যাশী। কোনোরকম জীবন চালিয়ে নেন। তাদেরকেও দিতে হয় বকশিশ।

 

রুবাইয়াত হোসেন নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, টিউশনি কিংবা পার্ট টাইম চাকরি করে আমরা যে আয় করি সেটি আমাদের দৈনন্দিন চলার খরচ হিসেবে চলে যায়। তারপরও কিছু টাকা সঞ্চয় করে বাবা মায়ের জন্য কাপড় নিয়ে যেতে পারলে মনে অন্যরকম আনন্দ কাজ করে। কিন্তু ঈদ বকশিশ হিসেবে প্রতিটি কর্মচারী কিংবা ডাইনিং বয়দেরকেও আলাদা করে টাকা দিতে হয়। এক্ষেত্রে আবার অল্প টাকায় তারা সন্তুষ্ট হন না। পরে বাধ্য হয়েই নিজের খরচের টাকা থেকে তাদেরকে বকশিশ দিতে হয়। মাহে রমজান আমাদেরকে ত্যাগের শিক্ষা দেয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের সাধ্যের বিষয়টি ও সবাইকে মাথায় রাখতে হবে।

 

সরকারের একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা (নাম গোপন করা হয়েছে) ঈদ বকশিশ নিয়ে নিজের বিড়ম্বনার কথা জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও বাধ্য হয়ে নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেছেন— উপরি ইনকাম না করা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ঈদ হলো একটা গলার কাঁটা। সবাইকে বকশিশ দিতে গিয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা; তবু অনেককে খুশি করা যায় না। মূলত, টেবিলের নিচ দিয়ে বাড়তি ইনকাম করা বড়-মাঝারি স্যারেরাই এই কালচারটা সৃষ্টি করেছেন।

 

তিনি বলেন— অফিস থেকে শুরু করে রাস্তা ঘাটে সবাই বকশিশ চেয়ে বসেন। দিলে আবার অল্পতেও খুশি না। বিষয়টি নিয়ে নিয়ে প্রত্যেককে সহনশীল ও দায়িত্বশীল আচরণ করা প্রয়োজন।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version