-->
শিরোনাম
আনন্দ ও বেদনার কান্না বিমানবন্দরে

বুকের ধন হাদিসুর কই ...

তরিকুল ইসলাম
বুকের ধন হাদিসুর কই ...
বিমানবন্দরে হাদিসুরের ছবি নিয়ে বাবা, মা ও ভাইয়ের আহাজারি। ছবি- ভোরের আকাশ

নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতার পর অবশেষে রোমানিয়া থেকে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’র ২৮ নাবিক দেশে ফিরেছেন। এ খবর পেয়ে বিমানবন্দরে মরদেহ গ্রহণ করতে ছুটে আসেন ইউক্রেনে রকেট হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স, বাবা-মা সহ স্বজনরা। বেঁচে যাওয়া নাবিকরা ফিরেছেন। কিন্তু আসেনি হাদিসুরের লাশ।

গতকাল বুধবার একে একে যখন ২৮ নাবিক বিমান থেকে নেমে আসছিলেন, তখন বাইরে অপেক্ষা ছিল স্বজনরা। প্রিয়জনদের কাছে পেয়ে কেউ কেউ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কেউ স্বজনদের জড়িয়ে ধরে আনন্দে কাঁদতে থাকেন। কিন্তু প্রিন্স তো এসেছিলেন ভাইয়ের লাশ গ্রহণ করতে।

একে একে সব নাবিক বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু ভাইয়ের কফিন তো আর আসে না। খবর এলো নিহত তরুণ প্রকৌশলী হাদিসুরের কফিন এখনো ইউক্রেনেই আছে। দেশের আনার প্রক্রিয়া চলছে। একটু সময় লাগবে। এ রকম একটি অনাকাক্সিক্ষত বার্তার জন্য হয়ত প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। তাই কান্নায় ভেঙে পড়লেন সবাই।

হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্সের কান্নায় বিমানবন্দরজুড়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বারবার মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছিলেন তিনি। তার গগনবিদারী আর্তনাদ দেখে কারো কি সাধ্য আছে চোখের জল আটকে রাখার। কোনো শান্ত্বনাই প্রিন্সকে শান্ত করতে পারেনি। পাশেই সন্তান হারানো বাবা-মায়ের আহাজারি।

এ দৃশ্য দেখে কান্না সামলে রাখতে পারেননি ২৮ নাবিকের পরিবারের সদস্যরাও। তবে শেষ পর্যন্ত ২৮ পরিবারের সবাই স্বজনদের সরকারিভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে হাসিমুখে বাড়ির পথে যাত্রা করেন। এর মধ্যে আনন্দ ও বেদনার সাক্ষী হয়ে রইলেন বিমানবন্দরে উপস্থিত সবাই।

ঘটনায় উপস্থিত সাংবাদিকরাও ভীষণ মন খারাপ করে আছেন, আনন্দের কান্না বা হাসি, কোনোটিতেই অংশ নিতে পারছেন না। কেউ কেউ মুখ লুকাচ্ছিলেন, আবার কেউ চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন। একটা সময় সবাই তথ্য সংগ্রহে মনোযোগী হলেন।

হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম মাওলা বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘ভাই কোথায়, তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন, আসেনি? এই, ভাই কোথায়? আহারে আমার ভাই... ভাই কবে আসবে? সবাই আমার ভাইকে ছাড়াই....’

তিনি বলেন, আমি তো বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছি নাবিকদের সঙ্গে আমার ভাইয়ের লাশ দেশে আসছে। তাই লাশ গ্রহণ করতে আমি এসেছিলাম। এসে খবর পেলাম লাশ আসতে আরো সময় লাগবে।

হাদিসুরের মরদেহ ইউক্রেনে একটি হিমঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং সুবিধাজনক সময় আনা হবে এমনটা আগেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও রাষ্ট্র্রদূতরা বেশ কয়েক দিন ধরেই বহুবার সেটি বলেছিলেন এবং গণমাধ্যমেও এ তথ্য ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে।

বিমানবন্দরে ২৮ নাবিককে গ্রহণ করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (ইস্ট-ইউরোপ) সিকদার বদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বুঝতেই পারছেন, যুদ্ধপরিস্থিতি চলছে ইউক্রেনজুড়ে। হাদিসুরের মরদেহ ফিরিয়ে আনতে আমরা আন্তরিক। এই অবস্থার মধ্যে তার সঙ্গীদের ফেরাতে পেরে আমাদের ভালো লাগছে।

তারা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’

হাদিসুরের মরদেহ কোথায় দাফন করা হবে এমনর প্রশ্নের জবাবে চাচাতো ভাই সোহাগ বলেন, বরগুনায় গ্রামের বাড়িতে করা হবে।

২০২১ থেকে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জহাজের মাস্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন জিএম নুর ই আলম। সিডিসি নম্বর- ৪৭৪২। বিমানবন্দরে নামার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সবার দোয়া এবং সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে আমরা ফিরতে পেরেছি। এজন্য শুকরিয়া। আমরা যখন ইউক্রেনে আটকে ছিলাম, তখন পররাষ্ট্র ও নৌ প্রতিমন্ত্রী আমাদের খোঁজখবর রেখেছেন। শিপিং করপোরেশন, দূতাবাস কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূতরাও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

তিনি বলেন, যে দিন থেকে যুদ্ধ শুরু হয়, সেদিন সকাল থেকেই চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিকেলে যখন আ্যটাক হয়, তখন আমরা নিয়মিত ডিউটিতে ছিলাম। জাহাজের ব্রিজে আগুন লেগে গিয়েছিল, এরপর আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে সীমান্তের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। অনেক মানুষ হেঁটে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করছে। কিন্তু আমাদের হেঁটে পার হতে হয়নি। হাদিসুরের মরদেহ ছাড়া চলে আসা নিয়েও আফসোস করেন জিএম নুর ই আলম।

মন্তব্য

Beta version