-->
শিরোনাম

কোভিড ১৯-এর মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে নেই

ড. আতিউর রহমান
ড. আতিউর রহমান
কোভিড ১৯-এর মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে নেই
ড. আতিউর রহমান

কোভিড-১৯ মহামারির আগে আমাদের উন্নয়নের ধারা ছিল গতিময়। প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন ছিল আট শতাংশেরও বেশি। আশা ছিল দারিদ্র্যের হার আরও কমবে। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ থেকেই বইতে লাগল করোনা-ঝড়। তছনছ করে দিল বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশেও সেই ঝড়ের ঝাপটা যে লাগেনি তা বলা যাবে না। তবে আমাদের লড়াই করে এগিয়ে যাবার অন্তর্নিহিত শক্তি এবং বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সংকটকালেও বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাকে অনেকটাই গতিময় রাখতে পেরেছে।

আন্তর্জতিক সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক প্রক্ষেপণ নিয়ে অনেকে মাতামাতি করেন। তবে আসল কথা হলো, এদের কাছে আমাদের অর্থনীতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই।

আমাদের পরিসংখ্যানও আমাদের অর্থনীতির পুরোটা ভালোভাবে ধরছে তা কিন্তু আমি দাবি করছি না। আমাদের প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে নানা ধরনের অনুমান দেখতে পাই। আইএমএফ এক রকম করে। আবার বিশ্বব্যাংক করে আরেক রকম। আইএমএফ খুবই রক্ষণশীল একটি সংস্থা। তাই বরাবরই তাদের প্রক্ষেপণ থেকে আমরা বাস্তবে এক-দুই শতাংশ বেশিই অর্জন করে থাকি। বিশ্বব্যাংকের অনুমান আরও গোলমেলে। তাদের মডেলও বিশেষজ্ঞদের মনোভাবের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের কাজ হলো কাজ করে যাওয়া। তারা একবার বলেছিলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি হবে ২ শতাংশ। বাস্তবে আমরা যখন ৫.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করলাম (এশিয়ায় সর্বোচ্চ); তখন কিন্তু তারা নিশ্চুপ। তবে সে বছর এডিবি বলেছিল আমাদের প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৮ শতাংশ। তাদের প্রক্ষেপণ আমাদের কাছকাছি ছিল। তাই দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রকৃত ধারা সঠিকভাবে আন্দাজই করতে পারছে না। ১.৬ থেকে ৬.৮ শতাংশের প্রক্ষেপণের মাঝে প্রায় পাঁচ শতাংশের মতো হেরফের। তাই বাইরের সংস্থাগুলো কী বলল বা বলল না তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমাদের নিজস্ব অর্জনের ভিত্তিভূমিকে খুঁজে নেওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।তা সত্ত্বেও আমাদের আত্মতৃপ্তিতে ভোগার দরকার নেই। বরং এই ভেবে আমরা খুশি যে সারাবিশ্বের প্রায় সব অর্থনীতি যখন সংকুচিত হচ্ছে; তখনও আমরা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির আভাস দিতে পারছি। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি, পুরো এশিয়ায় চতুর্থ এবং সারাবিশ্বে ষষ্ঠতম গতিময় দেশে হবার এই ইঙ্গিত দিচ্ছে সবচেয়ে রক্ষণশীল আন্তর্জতিক সংস্থাটি। সেটিই সবচেয়ে বড় কথা।

অংকের মারপ্যাঁচে না গিয়ে আমাদের নজর দেওয়া উচিত নিরন্তর ছুটে চলা বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিগুলোর দিকে। আমাদের প্রবৃদ্ধির গল্পটি খুবই কনসিসটেন্ট বা যুক্তিগ্রাহ্য। এই গল্প অন্তর্ভুক্তিমূলক। এই গল্প সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলার। এটি এক শ’ মিটার দৌড়ের গল্প নয়। এটি হাতে হাত রেখে ম্যারাথন দৌড়। ভুলে গেলে চলবে না, ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতির মোট আকার ছিল মাত্র ৮ (আট) বিলিয়ন ডলার। সঞ্চয় ছিল জিডিপির তিন শতাংশ। বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৯ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য ছিল। দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি। এক কোটিরও বেশি শরণার্থীর পাশাপাশি দেশের ভেতরে বিশ লাখেরও বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ির পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার চ্যালেঞ্জ ছিল। ছিল প্রতিকূল প্রকৃতি ও বিরূপ আন্তর্জাতিক রাজনীতি।

এমন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই জাতির পিতা এই বলে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন যে তাঁর বাংলাদেশে মানুষ পেট ভরে খাবে, বেকার কাজ পাবে, সুখী হবে, শিশুরা খেলবে, মায়েরা হাসবে। তাই আজ মনে রাখা চাই যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গল্পের পেছনে রয়েছে ৫০ বছরের পুরানো স্বপ্ন এবং আরও আগের অর্থাৎ ৭৫ বছরের পুরানো সোনার বাংলার আকাঙ্ক্ষা, যা জাতির পিতা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। এমন সংকটকালেও আমাদের অর্থনীতির যে শক্তিমত্তা আমরা দেখতে পাচ্ছি তা থেকেই অনুমান করা যায় যে এর একটি শক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভিত্তিভূমি রয়েছে। আর তাই তা বিশ্বের চোখে পড়ছে। বাংলাদেশের ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিশেষ করে জিডিপির অনুপাতে দেশি-বিদেশি দায় (ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত) এবং জিডিপির তুলনায় বাজারে টাকার সরবরাহ কম থাকায় (বাংলাদেশে ৫৫%, ভারতে ৮৫%), পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ন্ত এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্রিয়তায় এই সংকটকালে খুব দ্রুত লাখো কোটি টাকার ওপরে প্রণোদনা প্রদানের সাহসী উদ্যোগ নিতে পেরেছেন নীতিনির্ধারকরা। আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির গতিময়তায়। আমরা যখন ওই দিগন্তের দিকে তাকাব তখন নিশ্চয়ই বাইরের দুনিয়ার সাথে আমাদের সংযোগের কথা মনে রাখব।

কিন্তু আমরা আমাদের ভরসা ও সাহসের খোঁজ করব ভেতরে। আমাদের শক্তির উৎস সন্ধান ঘরে-বাইরে দুই দিকেই করতে হবে। বেশি করে তাকাতে হবে নিজের দিকে। আমাদের এই বিস্ময়কর উত্থানের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমাদের কৃষি। গ্রাম বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু আজীবন কৃষকের কল্যাণের কথা ভেবেছেন। সুদূর চীনে গিয়েও সেদেশের কৃষির রূপান্তর নিজের চোখে দেখে মনে মনে পরিকল্পনা করেছেন কী করে আমাদের কৃষির সংস্কার করা যায়। তাই তিনি কৃষির আধুনিকায়নে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি যে কৃষি খাতকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন, তাঁর কন্যার হাত ধরে আজ তা ব্যাপক মাত্রায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বিপুল হারে রেড়েছে। যদিও প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, তবু আমাদের শিক্ষিত তরুণরা কৃষি উদ্যোক্তা হবার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। উপর্যুপরি কয়েকটি বন্যা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কৃষি খাত এই সংকটকালে আমাদের অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে।

সরকার করোনা সংকট মোকাবেলার জন্য যে ত্বরিত প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল তার সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। প্রচলিত কৃষিঋণের বাইরেও বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার যে পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি চালু করেছে তার ৩৭% এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য এমএফআইয়ের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকার যে পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি চালু করেছে তার ৪৩% বিতরণ করা হয়েছে। এসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার ৩৩% বিতরণ করা গেছে। এর বড় অংশই গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পেয়েছেন। গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য বাদবাকি প্রণোদনার টাকা দ্রুত কৃষক ও ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে।

কৃষির পাশাপাশি রেমিট্যান্স আয় দ্রুতই বাড়ছে। গত অর্থবছরে তা বেড়েছিল ১১শতাংশ। এ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের অর্থবছরের ওই সময় থেকে তা ৪৮ শতাংশ বেড়েছে। চাকরি হারিয়ে যারা দেশে ফিরে আসছে তাদের জন্যও ২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। তাদের নয়া উদ্যোক্তা করা হচ্ছে এর মাধ্যমে। নতুন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফের বিদেশে পাঠানোর চেষ্টাও চলছে। আর রপ্তানি খাতের ভূমিকা তো আমরা সবাই জানি। ঘোর সংকটকালেও সরকার সহজশর্তে ঋণ দিয়ে গর্মেন্টসকর্মীদের বেতন নিশ্চিত করেছে সরকার। এখন চালু রপ্তানিশিল্প নতুন করে অর্ডার পাচ্ছে। এই খাতে বিপুলসংখ্যক নারীকর্মী কাজ করে বলে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে সামাজিক বিনিয়োগ যথেষ্ট অবদান রাখছে। বিশেষ করে সরকার গত এক দশক ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রশিক্ষণ, আইসিটি খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। ক্ষুধা ও জেন্ডার সূচকে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বখ্যাত। তা ছাড়া শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, স্যানিটেশন, বিনামূল্যে বই বিতরণ, শিশুদের সার্বজনীন টিকা প্রদান, মেয়েশিশুদের জন্য বিশেষ বৃত্তি, দুঃখী ময়েদের সামাজিক সুরক্ষা, জীবনের গড় আয়ুসহ গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির ব্যাপক রূপান্তর ঘটে গেছে এক সময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামের অবহেলিত বাংলাদেশে। বিশ্ব এখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। তা ছাড়া, সব ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, সামাজিক উন্নয়নে ব্যক্তি ও এনজিও খাতকে উৎসাহ প্রদান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ অসাধারণ সক্ষমতা দেখিয়েছে। তবু সামাজিক শক্তি অর্জনে কিছুটা ঘাটতি রয়েই গেছে। দুর্নীতি দূর করার প্রশ্নে আরও অনেকটা পথ আমাদের হাঁটতে হবে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার গরিবহিতৈষী অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশলে যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়ে চলেছে। এই ধারাকে আরও সমর্থন দিয়ে যেতে পারলে আগামী দিনে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের উপাখ্যানটি আমরা আরও জোরালোভাবে বলতে পারব। সে জন্যে আমাদের নীতি সমর্থন যেন পিরামিডের নিচের দিকে বেশি করে বজায় থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

সবশেষে বলতে চাই : ১. মানুষের ওপর বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক সুরক্ষার ওপর বিনিয়োগ ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে হবে।২. আমাদের কৃষিতে আরও প্রযুক্তি ও অর্থের জোগান বাড়িয়ে তাকে বহুমুখী ও উদ্যোক্তাবান্ধব করে যেতে হবে। ৩. বিশ্ব অর্থনীতির সাথে আমাদের সরবরাহ চেইনকে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করে কৃষিসহ সব খাতে মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে।৪.দেশি সরবরাহ চেইনকে আরও আধুনিক ও ডিজিটাল করে আমাদেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি আন্তর্জাতিক ভ্যালু-চেইনেও আমাদের সংযুক্তি বাড়াতে হবে।৫. কোভিড-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে সবুজ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার লক্ষ্যে কৃষি, অবকাঠামো এবং মনবপুঁজির দিকে আরও নীতি মনোযোগ দিতে হবে।৬. এর জন্যে টেকসই অর্থায়নের কোনো বিকল্প নেই। তাই টেকসই অর্থায়ন আরও জোরদার এবং গভীর করতে হবে।৭. সরকারি আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটিয়ে আরও দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে।৮. প্রয়োজনে বাজেট ঘাটতি আরেকটু বাড়িয়ে নিম্নবিত্ত ও গরিবের জন্য সামাজিক সুরক্ষা আরও বাড়াতে হবে। বিপন্ন মধ্যবিত্তের জন্য আরও কর ও ভ্যাট ছাড়ের কথা ভাবতে হবে (যেমন- ছোট ও মাঝারি বাড়িওয়ালাদের জন্য কর ছাড়)।৯. কৃষক, ঝুঁকিতে থাকা কুটিরশিল্পের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সর্বক্ষণ ডিজিটাল মনিটরিং করে যেতে পারে (ন্যাশনাল ডিজিটাল ড্যাশবোড-ভিত্তিক মনিটরিং)।আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ সঠিক পথেই হাঁটছে। সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং অর্থনীতির সমন্বয় করে সকল অংশীজনকে সহযোগী করে এগিয়ে যাওয়ার যে সুযোগ কোভিড-উত্তর বিশ্বে আসতে যাচ্ছে তার সদ্ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অগ্রগামীই থাকবে।

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

মন্তব্য

Beta version