আমাদের সমাজটা যেন আগের মতো আর নেই। অধিকাংশ পরিবারে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেলে সন্তানরা তাদের দায়দায়িত্ব নিতে চায় না। জোরপূর্বক তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কেউবা পিতা-মাতার কাছ থেকে সম্পত্তি লিখে নিয়ে তাদের গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে। সন্তান তার বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে চাকর-বাকরের মতো আচরণ করতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার লাঞ্ছনা এতটাই সামাজিক উদ্বেগের কারণ যে, প্রশাসন, আদালত ইত্যাদির হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় বেশকিছু ক্ষেত্রে। পিতা-মাতার ভরণপোষণ যে সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক, এও অনেক সময় আদালতের রায় দ্বারা নির্ধারিত হয়। এর চেয়েও দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী তো অনেকেই আছেন। সংবাদপত্রের পাতায় বা খবরের চ্যানেলে আজকাল দেখা যায়, বৃদ্ধ পিতাকে যুবক সন্তান মারধর করছে, মারতে মারতে মেরেও ফেলছে। কখনো অসহায় বাবা মাকে স্টেশনে ভিক্ষাপাত্র হাতে বসিয়ে দিয়ে আসছেন তাদেরই আত্মজ অথবা আত্মজারা!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম অবস্থা আজ কেন? কেন এই অবহেলা, অসম্মান ও অপ্রাপ্তি? মা দশ মাস দশ দিন সন্তানকে গর্ভধারণ করেন। জš§দানের সময় কষ্টভোগ করেন। দুধ পান করান এবং আদর-যত্নে বড় করে তোলেন। পিতাও আদর-সোহাগ দানের পাশাপাশি সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করেন। মায়ের অবদান বেশি হলেও পিতার অবদান মোটেও কম নয়। বর্তমানে সরকারি আইন ও নিয়মানুযায়ী সন্তানরা মা-বাবার দেখভাল করে যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন বলে আশা রাখা যায়। কিন্তু আমাদের সমাজ কেন ভূমিষ্ঠ শিশুটিকেও শুধু সেই প্রসব সময়ের অংশীভূত করে? কেন শিশুটির পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক, পারিপাশির্র্^ক মাধ্যম তাকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে না যাতে তার স্মৃতিতে, সত্তায় পিতা-মাতার এই অংশগ্রহণ, তার জন্মমুহূর্ত থেকে বড় হওয়ার প্রতিটা ক্ষণে বাবা-মায়ের ভূমিকা, সহায়তা সবকিছুকে সে আর ভুলতে না পারে? এটা তাকে মনে করিয়ে দেওয়ার কেউ থাকে না বলেই কি বৃদ্ধ পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অত্যাচারের সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আজ প্রকাশিত ও প্রচারিত হতে দেখা যায়।
একটু গভীরভাবে দেখলে, একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তাকে ঘিরে কেবল ‘আমার সন্তান আমার সন্তান- আমার সন্তান’- এই ভাবনাও কি শিশুটিকে অজান্তেই স্বার্থপর, আত্মমগ্ন, নার্সিসাস কওে তুলছে না?
একটি পরিবারের একটি শিশু কেবল তার পিতা-মাতার সন্তান নয়। সে হয়তো কারও নাতি-নাতনি, ভাইপো-বোনপো, ভাগনি, বোনঝি, ভাই-বোন অথবা আরও অন্য কোনো সম্পর্কে যুক্ত। আবার কেবল নির্দিষ্ট পরিবারের সঙ্গেই শিশুটি কেবল যুক্ত হতে পারে না। সে তার প্রতিবেশের অংশ, সে সেই সংশ্লিষ্ট সমাজের, রাষ্ট্রেরÑ সর্বোপরি এই পৃথিবীর একটি অংশ। এই চেতনা তার মধ্যে কীভাবে সঞ্চারিত হবে? কাকে দেখে শিখবে সে? আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, স্কুল-কলেজ কোথায় সে সেই শিক্ষার সুযোগ পাবে?
এদিকে যে দেশে পরিবারে দুইয়ের অধিক সন্তান, সেই সব পরিবার তাদের সন্তানকে ভবিষ্যৎ অর্থ রোজগারের একটি মাধ্যম হিসেবে মনে করেন। কোথাও আবার ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই একাধিক সন্তানের জন্ম দেন পিতা-মাতা। ইন্দোনেশিয়ার একটি গ্রামে নয়টি সন্তানের পিতাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি সুখী নয় সন্তানের পিতা হিসেবে? ওদেও প্রত্যেকের শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ে আপনার কোনো উদ্বেগ নেই?’
পিতা উত্তর দেন, ‘আমি গর্বিত। আমার ওদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ে ভাবার কী প্রয়োজন? ওরাই আমার অর্থনৈতিক সুরক্ষা।’ নয় সন্তানের মধ্যে মাত্র একজনই স্কুলে যায়। বাকিরা বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে উপার্জন করে পরিবারের অর্থনৈতিক অভাব দূর করে। বাংলাদেশেও এমন বাস্তবতা আছে।
বর্তমানে বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবার এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। অর্থাৎ নিউক্লিয়ার পরিবার। এই নিউক্লিয়ার পরিবারের সদস্য বাবা, মা ও সন্তান। তাই সন্তান নিজের বাবা-মাকে তাদের পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে দেখেনি তেমন। দায়িত্ব পালন বিষয়ে তার মনে কোনো ধারণাই নেই। তা হলে কীভাবে সেই সন্তান বড় হয়ে তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেবে?
ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেমেয়েরা খুব অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বিদেশ-বিভূঁইতে খুব ভালো চাকরির মোহে চলে যাচ্ছেন। আবার সাধারণ, মধ্য মেধার ছাত্রছাত্রীরাও কর্মসংস্থানের অভাবে সেই প্রবাসেই পাড়ি দিচ্ছেন। অথচ প্রবাসের চাকরিজীবনে তেমন অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নেই। নিজেরাই পরবাসে স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলতে পারছেন না যারা, তাদের পিতামাতারও একই পরিণতি! শিশু জন্মমুহূর্তে প্রসূতি মায়ের প্রসব উপযোগী অক্সিটোসিন হরমোন ক্ষরণের জন্য শিশুর সঙ্গে বন্ধন বা নিবিড় অন্তরঙ্গতা খুব প্রয়োজনীয়। সেই একই অন্তরঙ্গতা আজীবন লালন করা, মা শিশু ও পিতা তিনজনেরই আরও বেশি প্রয়োজন। এই সমাজের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার তাগিদেই শিশুকেও সেই প্রসব মুহূর্ত উপলব্ধির অংশীদার করা জরুরি। আগামী পৃথিবী সুন্দর ও সুরক্ষিত করে তোলার জন্যই এ এক অতি আবশ্যিক চেতনা। সন্তান যেন তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালনে কোনোরকম ত্রুটি না করে, সন্তানরা এভাবে গড়ে উঠুক। এভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব বাবা-মায়েরও রয়েছে। পিতৃ ভক্তি, মাতৃ ভক্তি, গুরু ভক্তি উঠে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এদিকে অনেক কাল ধরেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য, গুরুজনের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা, সহবত, শিষ্টাচার ও নাগরিক কর্তব্য আর শেখানো হয় না।
আগে বাসাবাড়িতে বাবা-মা ছেলেমেয়েদেও প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। অপরদিকে স্কুলের মাস্টার মশাইরা অর্থাৎ স্যারেরা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ছেলেপুলেদের যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার জন্য কড়া নজর রাখতেন। মাস্টার মশাইদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার রীতি ছিল। প্রাচ্য শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুগৃহে থাকার কালের এই রীতি বা ধারা বংশপরম্পরায় চলে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে ম্যাকলের পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার পর আস্তে আস্তে সংস্কৃত টোল ও সরকারি অনুদান বন্ধ করে জোরজবরদস্তি করে এই শিক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করা হয়। নবজাগরণের পথিকৃৎরা পাশ্চাত্যের আলোকে আলোকিত হতে প্রাচ্যের ঘরানা বা ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেওয়ার এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে কিন্তু সরব হননি। তাদের চোখে তখন টুলো পণ্ডিত অশ্রদ্ধার ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। ওদিকে সুশিক্ষা না পেয়ে অনেকেই বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করতে ভুলে গেল। ক্রমে ক্রমে এটাই দাঁড়াল যে, বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে, আয়-উপার্জন করতে না পারলে তারা সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াল পর্যায়ক্রমে।
প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যের চর্চা ও অনুসন্ধিৎসা গলা টিপে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর দিন যতই গেল প্রাচ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে পড়বে বলে দোহাই পেড়ে মাস্টার মশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম তো দূরস্থান, তাঁদের পেটানোর দৃষ্টান্তও তুলে ধরেন। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে এ বিশবিদ্যালয়, সে বিশবিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘেরাও ও চূড়ান্ত অসম্মান করে শিষ্টাচার ও সহবত শিক্ষাকে আজিমপুরের কবরস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অথচ সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়তে হলে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এই শিক্ষা অর্থাৎ বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন যে অপরিহার্য, তা আজও কারো চিন্তাভাবনায় নেই। আর স্কুল-কলেজে আজ এই প্রবল অসহিষ্ণুতার মূলে যে এই পাঠ্যাতিরিক্ত শিক্ষার অভাব, তা কবে নজরে আসবে কর্তৃপক্ষের? বাবা-মায়ের প্রতি দায় দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন কিংবা শিক্ষকের প্রতি যারা শ্রদ্ধা দেখাতে জানে না তাদের ভবিষ্যৎ বড়ই অন্ধকার।
লেখক : ভ্রমণবিষয়ক গ্রন্থ রচয়িতা
মন্তব্য