-->

এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি কেন?

ড. মিহির কুমার রায়
ড. মিহির কুমার রায়
এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি কেন?

বর্তমান অর্থবছরের (২০২১-২২) জন্য ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্পের বিপরীতে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি ৯ লাখ টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা বিগত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। এছাড়া সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১০ প্রকল্পে ৫৪ হাজার ৪৫১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূল এডিপির পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা প্রায় ১১ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার এডিপি অনুমোদন করা হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত ৮৯টি প্রকল্পসহ মোট ১ হাজার ৫১৫টি প্রকল্পের বিপরীতে এডিপির মোট আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি ৯ লাখ টাকা।

বিগত অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) বরাদ্দ ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা যার সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা নিজস্ব অর্থায়নে ১১ হাজার ৬২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে এডিপি বাস্তবায়ন করবে। সংশোধিত এডিপির মোট আকার ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

উল্লেখ্য, অন্যান্য বছরের মতো এবারও দেশজ সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস তথা জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা কৌশল এবং লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। অনুমোদিত এডিপির ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৯ কোটি ৯১ লাখ ও বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন ৮৮ হাজার ২৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ১১ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন ৬ হাজার ৭১৭ কোটি ৪৮ লাখ এবং বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন ৪ হাজার ৭৫১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১ হাজার ৪২৬টি প্রকল্পের মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ৩০৮টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১১৮টি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে ৮৯টি প্রকল্পসহ মোট প্রকল্প ১ হাজার ৫১৫টি।

সার্বিক মূল্যায়নে দেখা যায়, বিগত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে ১৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের ৮.২৬ শতাংশ, বৈদেশিক সহায়তা প্রকল্পের অংশে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭.২১ শতাংশ। অথচ এদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল মোট বরাদ্দের ৭.৭৪ শতাংশ। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের তিন মাসে ব্যয় হয়েছিল ৫.৮৯ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.৬৫ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় হয়েছিল ১২.৮৬ শতাংশ।

এদিকে অর্থবছরের ৩ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ১ শতাংশের নিচে বৈদেশিক অর্থ খরচ করেছে ৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এর মধ্যে এক টাকাও খরচ করেনি চারটি মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো-পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।

এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ব্যয় করেছে ০. ৫৮ শতাংশ এবং নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ০.৭৯ শতাংশ বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ খরচ করতে পেরেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরাজ করছে ধীরগতি যার ফলে কাক্সিক্ষত বাস্তবায়ন না হওয়ায় সার্বিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

ফলে চলতি অর্থবছরের চার মাসের মাথায় (জুলাই-অক্টোবর) এসে এডিপি কাটছাঁটের প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। বৈদেশিক অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংশোধিত এডিপি তৈরির জন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। এরপরই আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হবে সিরিজ বৈঠক ও সেখানে আলাপ-আলোচনা করে নতুন বরাদ্দ নির্ধারণ করা হবে।

উল্লেখ্য, এডিপির শুরুতেই ইআরডি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বরাদ্দ নির্ধারণ করে কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে পরবর্তীকালে সেই বরাদ্দ সংশোধন করতে হয়। তবে এবার এর ব্যতিক্রম। কারণ করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে বিশেষ করে অনেক প্রকল্পের পরামর্শক চলে গেছেন যারা এখনো ফিরে আসেননি এবং এলেও কেবল কাজ শুরু করেছেন।

এছাড়া যন্ত্রপাতি ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতে টেস্টিং ও কমিশনিংয়ের বিষয়গুলো আটকে ছিল। ফলে নানা কারণে বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার কম হচ্ছে। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য হলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বৈদেশিক প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। প্রকল্প তৈরি, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন সব পর্যায়ে এই দুর্বলতা প্রকট। ফলে বরাদ্দ দেওয়া অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করতে পারে না।

এছাড়া দেশীয় অর্থ ব্যবহার করা যতটা সহজ, বৈদেশিক অর্থ ব্যয় করা অতটা সহজ নয়। এখানে যারা ঋণ সহায়তা দেয় তাদের নানারকম শর্ত থাকে, কঠোর তদারকি থাকে, হিসাব পদ্ধতি ভিন্ন, নয়-ছয় করার সুযোগ কম থাকে। ফলে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো দেশীয় অর্থ ব্যবহারে যতটা আগ্রহী থাকে বৈদেশিক অর্থের ক্ষেত্রে সেটি থাকে না যদিও চলাচলের জন্য গাড়িসহ অনেক প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে। এখন কেন এক প্রান্তিকে এসে বৈদেশিক অর্থ সাহায্য সরলীকরণের প্রয়োজন হলো তা অবশ্য আলোচনার দাবি রাখে।

উল্লেখ্য, ১১ অক্টোবর বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এমন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং সিনিয়র সচিবদের কাছে পাঠানো চিঠিতে প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) কর্তৃক। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি তৈরির জন্য সব চলমান এবং অনুমোদিত নতুন প্রকল্পের বৈদেশিক সহায়তা অংশের প্রাক্কলন নির্ধারণ করা হবে।

এক্ষেত্রে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যয় বা বাস্তবায়ন অগ্রগতির ওপর নির্ভর করা হবে যা ১১ নভেম্বরের মধ্যেই তথ্যগুলো চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু প্রকল্পের হিসাব পাওয়া শুরু হয়েছে এবং আশা করা যাচ্ছে, সব তথ্য পেলে আগামী ডিসেম্বর মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করা হবে। সেখানে আলাপ-আলোচনা করে সবকিছু নির্ধারণ করে প্রস্তাব আকারে পাঠানো হবে পরিকল্পনা কমিশনে যেখানেই পুরো এডিপি সংশোধনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

গত অর্থবছরের (২০২০-২১) সংশোধিত বাজেটের ‘মাত্র’ ৭৪ শতাংশের মতো খরচ হয়েছে এবং গত পাঁচ বছর ধরেই দেখা গেছে, বাজেটের ৮৪ থেকে ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। ফলে বাস্তবায়নের এই হ্রাসকৃত হার নিঃসন্দেহে আমলে নেওয়ার মতো। এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, ২৬ শতাংশ বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার বড় কারণ চলমান করোনা পরিস্থিতি।

করোনার ঊর্ধ্ব সংক্রমণ, লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল কিংবা ধীরগতিতে চলেছে। তবে করোনার মধ্যে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে পারলে এর চেয়ে বেশি হারে বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। বাংলাদেশে বাজেট পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার বেশ কিছু কারণ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে যা সরকার এ বিষয়ে ওয়াকিফহাল।

বিভিন্ন সময় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। আসলে বাজেট বাস্তবায়নের কাজ যারা করেন তাদের মধ্যে গাফিলতি লক্ষ্য করা যায় যা করোনাকালে এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি বরাদ্দ করা অর্থ ছাড় নিয়েও সমস্যা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সময়মতো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে অর্থ ছাড় করলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়ের হাতে পৌঁছাতে যেসব ধাপ পেরোতে হয়, সেখানে বেশ সময় যায়।

এ ছাড়া যন্ত্রপাতি, জনবলের ঘাটতিও বাজেট বাস্তবায়ন কম হওয়ার কারণ। গত অর্থবছরে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে অনেক কম যা উন্নয়ন বরাদ্দের ৬২ শতাংশ। সরকারের উন্নয়ন ব্যয় কম হলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়। বাজারে পণ্যের চাহিদা ও মুদ্রা সরবরাহ কমে যায়। স্বাভাবিকভাবেই সরকার পরিচালন ব্যয়ও কম করেছে। আরও বিভিন্ন খাতে ব্যয় কম হয়েছে। করোনার কারণে কিছু খাতে চাহিদা কমেছে। আবার কিছু খাতে ব্যাপক ব্যয়ের চাহিদা তৈরি হয়েছে।

চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এমন খাতে বরাদ্দের চেয়ে অধিক ব্যয় করার দৃষ্টান্ত ২০২০-২১ অর্থবছরেই রয়েছে। আবার চাহিদা বাড়লেও বরাদ্দের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতে না পারার ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তার বাজেট সমাপনী বক্তৃতায় মহান জাতীয় সংসদে বলেছেন, করোনা মোকাবিলা করে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং অর্থমন্ত্রী বলেছেন, অর্থের কোনোরকম অভাব হবে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা মানেই এর সাথে সংযুক্ত জনশক্তি তথা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতা, যা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এর উন্নয়নের গতিধারায় কবে নাগাদ এই সক্ষমতা একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছাবে তা বলা দুষ্কর।

দেশ উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে যে গতিতে, তার চেয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির গতি আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য প্রশিক্ষণ ও তদারকির কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে একটি রোড ম্যাপ ধরে এগোতে হবে। আবার উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যয়ের মান উন্নয়ন ও অনিয়ম প্রতিরোধে উদ্যোগী মন্ত্রণালয়, বাস্তবায়নকারী সংস্থা, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ অনু বিভাগকে উন্নয়নের সহযাত্রী হিসেবে কাজ করতে হবে।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ, ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

মন্তব্য

Beta version