-->

প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্য ব্যবহার

আবু আফজাল সালেহ
আবু আফজাল সালেহ
প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্য ব্যবহার

সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মানুষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে, যা জীবনযাপনকে করেছে সহজতর। কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে। প্লাস্টিকবর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ যেন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিকল্প-সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে। ক্যারি-ব্যাগ থেকে ওষুধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলের টব পর্যন্ত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চটের ব্যাগ হোক কিংবা কাচের শিশি অথবা চিনেমাটির থালা কিংবা মাটির টব ইত্যাদির পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। অপেক্ষাকৃত সস্তা, বহনযোগ্য হওয়ার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে পলিমারে তৈরি সামগ্রী। এর ব্যবহার নিয়ে তেমন আপত্তি নেই, আবার আছে। কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলোকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আপত্তি তাতেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহার করা প্লাস্টিকের সামগ্রী যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না, এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই লোকালয়ের বুকে ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে। আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ। পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরও বিপদ, হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, যেভাবে দূষণ বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালে সমুদ্রে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের সংখ্যা বেশি হবে। এর মোকাবিলা কীভাবে হবে, তা নিয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। এর মধ্যেই খবর মিলেছে, অ্যামেরিকায় আগামী এক দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন বাড়বে ৪০ শতাংশ। কোথায় যাবে এই বিপুল বর্জ্য? এ যেন গোটা পৃথিবীর দূষিত আস্তাকুঁড়ে হয়ে ওঠার অশনিসংকেত! এতে একসময় দেখব, আমরা খাবার টেবিলে মাছ না খেয়ে প্লাস্টিক খাচ্ছি। কেননা প্লাস্টিক বর্জ্য নদ-নদী ও সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। মাছ সেসব খেয়ে বেড়ে উঠছে। এতে আমাদের শরীরেও নানাভাবে অসুখ-বিসুখ আরো ছড়াবে।

সাধারণ প্লাস্টিকের ব্যাগগুলোর শতকরা ১০০ ভাগই কৃত্রিম পলিথিনের, যা জীবাশ্মের অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি। এই ব্যাগগুলো মোটেই পরিবেশবান্ধব নয় এবং এগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ বছর সময় লাগে। বিষয়টি ভাবা যায়? তাই প্লাস্টিকের বিকল্প এখনই আমাদের ভাবতে হবে। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে আমাদের কৃষি ও শিল্পকারখানার বিকাশ হবে। কিছু ব্যাগ আছে ‘ইউজ এন্ড থ্রো’।

একবারই ব্যবহার করা হয় এগুলো। অর্থাৎ অনটাইম প্লাস্টিক ব্যবহার আরো ক্ষতিকর। এমন প্লাস্টিকেরও ব্যাগ রয়েছে যেখানে শতকরা ৭০ ভাগ থাকে রিসাইক্লিং পলিথিন। জৈবিক উপায়ে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়, এমন প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া যায় আজকাল। তবে সেইসব প্লাস্টিকের ব্যাগ সাধারণত শতকরা ৭০ ভাগ অপরিশোধিত তেল এবং ৩০ ভাগ নবায়ণযোগ্য কাঁচামাল থেকে তৈরি। এতে পুনঃউৎপাদনেও সীমাবদ্ধতা আছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেন। এতে পরিবেশও দূষণ হয়। তবে কম মাত্রায়। অন্যদিকে কাগজের ব্যাগ যে সব সময়ই পরিবেশবান্ধব অর্থাৎ কৃত্রিম ব্যাগের তুলনায় ভালোÑ তাও কিন্তু নয়। কারণ, এসব ব্যাগ তৈরিতে অনেক বেশি সময় এবং ব্লিচিং করার জন্য শক্তিশালী রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তীতে আবারো রাসায়নিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। এতে কিছুটা হলেও দূষণ ঘটে। তাই যতটা সম্ভব এগুলোর ব্যবহারও কম করতে হবে। আরো ভালো বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সবুজ বিপ্লব করতে হবে। কিছু দেশের এ ব্যপারে কর্মপরিকল্পনা আলোচনা করতে পারি। সুফল পাওয়া পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারি।

২০১৮ সালের গোড়াতেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে জানান, ২০৪২ সালের মধ্যে ব্রিটেনকে স¤পূর্ণ প্লাস্টিকমুক্ত করাই তার লক্ষ্য। একটি স্লোগানও দিয়েছেন তিনি, ‘ক্লিনার, গ্রিনার ব্রিটেন’। সুপারমার্কেটগুলোর কাছে তার আবেদন ‘প্লাস্টিকের ব্যবহার স¤পূর্ণ বন্ধ করুন’Ñ এ রকম পরিকল্পনা আমরাও গ্রহণ করতে পারি। মন্দ নয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান। লুক্সেমবুর্গ, ডেনমার্কের মতো বহু দেশ প্লাস্টিক ব্যাগের উপর বিপুল পরিমাণ কর বসিয়েছে। জার্মানির সুপারমার্কেটগুলো প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে বারবার ব্যবহার করা যায় এমন অন্য ব্যাগের ব্যবহার চালু করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশ কমছে। এ রকম পরিকল্পনা আমরাও হাতে নিতে পারি।

প্লাস্টিক বা পলিমার জিনিসপত্রের উপর বেশি পরিমাণে কর বসিয়ে প্লাস্টিক সামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দিতে পারি। অন্যদিকে পাট বা পরিবেশবান্ধব জিনিসপত্রে ভর্তুকি দিয়ে ও সাহায্য সহযোগিতা করে দাম কমিয়ে ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগী হতে পারি। ২০১৭ সালের শেষের দিকে সুদূরপ্রসারী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেনিয়া। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কেনিয়ার কোথাও প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন করা যাবে না। ব্যবহারও করা যাবে না। কেউ নতুন নিয়ম না মানলে তার চার বছর পর্যন্ত জেল এবং ৩৮ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, মাসে কেনিয়ায় প্রায় ২৪ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হতো। এর সুফল পেয়েছে কেনিয়া। কমতে শুরু করেছে প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার। আমাদের দেশেও পলিথিন ব্যবহারে আইন আছে। তবুও ব্যবহার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে পরিবেশের স্বার্থে। প্রয়োজনে আইনকে আরো যুগোপযোগী করতে হবে। নাস্তা বা খাবার প্যাকেটে প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। জিম্বাবুয়েও এ ব্যাপারে ভালো একটা পদক্ষেপ নিয়েছে। প্লাস্টিকের তৈরি স্টাইরোফোম বাক্স (খাবার পরিবেশন করা হয় যাতে) বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিকল্প হিসাবে কাগজের তৈরি নতুন বাক্স তৈরি করার চেষ্টা করছে তারা। বিভিন্ন ফাস্টফুড সেন্টারে প্যাক করে খাবার না দিয়ে ক্রেতাদের রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া দাওয়া করতে উৎসাহ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আমরাও এ নীতি অনুসরণ করতে পারি।

প্রকৃতপক্ষে সকালে ঘুম থেকে ওঠে দাঁত ব্রাশ থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের জীবনে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ব্যাপক হারে দেখতে পাওয়া যায়। সকালে ওঠে যে ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করি এবং যে টিউব থেকে টুথপেস্ট আসছে, তার সবকিছুই প্লাস্টিকের তৈরি। এ ছাড়া দিনে প্রতিটি খাবার এবং জীবনযাত্রায় প্লাস্টিক পণ্য এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক দূষণ বাংলাদেশেও ক্রমবর্ধমান একটি সমস্যা। বাংলাদেশ এক বছরে ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি করে। প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি করে; যা বছরে মোট সৃষ্ট বর্জ্যরে ৮ শতাংশ। প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিদিন সমুদ্রে মিশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীর মাধ্যমে। এ থেকে বোঝা যায়, প্লাস্টিক দূষণ রোধ করা কতখানি জরুরি। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০০ বিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। কারণ, ব্যবহৃত প্লাস্টিক শেষ পর্যন্ত নদী, সাগর ও কৃষি জমিতে স্থান পায় এবং সেসব গলতে বা টুকরো হতে বহু বছর সময় লেগে যায়। ফলে মাটি ও পানির দূষণ অব্যাহত থাকবে। ব্যাগ এবং প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন হতে পারে পাটের মতো পরিবেশবান্ধব পণ্য দিয়ে। পাট যেমন স্বাস্থ্যকর সবজি, তেমনি পাট থেকে তৈরি হয় মজবুত সুতা। তাছাড়া পাট প্রাকৃতিক আঁশ এবং দামেও সস্তা। ব্যবহারের দিক থেকে তুলার পরেই পাটের স্থান। তাছাড়া পাট মজবুত ও টেকসই হলেও তা রিসাইকেল করাও সম্ভব। পাটের তৈরি ব্যাগ দেখতে সুন্দর, আধুনিক ও মজবুত। এই ব্যাগ ব্যবহারে যেমন পকেটের পয়সা বাঁচবে, তেমনি পরিবেশ সুরক্ষা হবে।

দায়িত্বশীল নাগরিকদের উচিত সরকারকে সহায়তা করা। পাটের ব্যবহার পরিবেশ রক্ষায় রাতারাতি কোনো সমাধান নাও আনতে পারে। তবে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে সহায়তা করবে। শুধু নিয়মিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে প্লাস্টিকমুক্ত ভবিষ্যৎ আশা করতে পারি। এখন থেকে পাটের তৈরি পণ্য বেছে নিই এবং পরিবেশ পরিবর্তনের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করি।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

মন্তব্য

Beta version