-->
শিরোনাম

উন্নয়নের স্বার্থে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

ড. আলাউদ্দিন
ড. আলাউদ্দিন
উন্নয়নের স্বার্থে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

সমাজকে গভীরভাবে জানার একমাত্র পন্থা গবেষণা। গবেষণা ব্যতীত কোনো জাতি তার নিজ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারে না; উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাক্কালে তা পরিলক্ষিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অপেক্ষা বেশ কয়েক মাস পরে এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটলেও বাংলাদেশ গবেষণা বা পূর্বপরিকল্পনার অভাবে, কিংবা বলা যায় মহামারীর ব্যাপকতা অনুধাবনে ব্যর্থতার দরুন শুরু থেকেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে' লকডাউন, টিকা ব্যবস্থাপনা এবং পরিবহন/চলাচল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে।

গবেষণা ব্যতীত উন্নত দেশসমূহ না নিজেদের ইতিহাস জানে, না বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। বাংলাদেশে ইতিহাস, গবেষণা বা জ্ঞান অন্বেষণ প্রসঙ্গে ডাচ ইতিহাসবিদ-বাংলাদেশ গবেষক উইলেম ভ্যান সেন্ডেলের মূল্যায়ন যথার্থ। তিনি ‘ফ্রান্সিস বুকানন ইন সাউথইস্ট বেঙ্গল ১৭৯৮’ গ্রন্থে (১৯৯২) যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন যে, সমসাময়িক বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে অনুন্নয়নের আরেকটি দিক, যা প্রায়শই উপেক্ষা করা হয় তা হলো, ‘জ্ঞানের অনুন্নয়ন’ (আন্ডারডেভেলপমেন্ট অব নলেজ)। ঐতিহাসিক জ্ঞানের (হিস্টোরিক্যাল নলেজ) ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট। ফলে অনুন্নয়ন মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিগুলো গৃহীত হয় সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বোঝাবুঝির ওপর ভিত্তি করে। গবেষণা বা প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টির স্থলে প্রাধান্য পায় অনুমান। ভ্যান সেন্ডেলের মতে, এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গবেষণার অনুন্নয়নের ফল। দুঃখজনক হলেও সত্য, উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদরাও মনে করেন, ঐতিহাসিক গবেষণা বিলাসিতা থেকে একটু বেশি। অথচ উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, দেশকে জানতে হলে, দেশের ইতিহাস ও সমস্যাদি বুঝতে হলে এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐতিহাসিক জ্ঞান ও গবেষণা অনস্বীকার্য।

গবেষণা কাকে বলে? তথ্য বিন্যস্তকরণ ও নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য উপকরণ এবং উৎসগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও অধ্যয়নই গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাদির প্রকৃতি ও গভীরতা জানা যায় এবং একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পন্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। সামাজিক সমস্যাদি বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক মেরামত করে, যা স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য তথা মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিধানে গবেষণা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। গবেষণার মাধ্যমে অতীত সর্বদা বর্তমান থাকে। ফলে কোনো জাতিকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় না। উন্নত দেশগুলোয় তাই অতীত নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক বা তথ্যবিভ্রাট নেই; যতটা বাংলাদেশের মতো অ-উন্নত দেশে দেখা যায়।

গবেষণার ফলে ভাইরাসের নানা প্রকরণ ও গতি-প্রকৃতি যেমন জানা গেছে, তেমনি ওষুধসহ টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। যদি গবেষণালব্ধ উপায়ে টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব না হতো, এই মহামারির পরিণতি লেখা বা পড়ার জন্য মানুষ জীবিত থাকত কিনা বলা মুশকিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ সর্বত্র এখন গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার গবেষণার ওপর মনোযোগ প্রদানের জন্য শিক্ষক ও চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে গবেষণায় গতি কম।

মূলত যে দেশ যত বেশি গবেষণানির্ভর, সে দেশ তত বেশি অগ্রসরমাণ। যে দেশে যত বেশি গবেষণার জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অনুক‚ল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়Ñ সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশে পুনঃপুন গবেষণা ব্যতীত অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়, সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২.০৯ ভাগ, যেখানে ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ ভাগ বরাদ্দ রাখা উচিত। সুতরাং গবেষণার প্রণোদনা সহজেই অনুমেয়।

তবে বাংলাদেশের গবেষণার অন্যতম সমস্যা সঠিক বণ্টন ও যোগ্য ব্যক্তিকে গবেষণার সুযোগ প্রদান। আর্থিক বরাদ্দ যাই থাকুক না কেন, তার যথাযথ ব্যবহারই মূল চ্যালেঞ্জ। বরাদ্দকৃত অর্থ সত্যিকার অর্থে গবেষণা খাতে যথাযথভাবে ব্যয় হয় না; এমনকি অব্যয়িত থেকে যায়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে গবেষণার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গবেষণার জন্য (সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল) ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বছর শেষে জানা যায়, গবেষণার জন্য একটি টাকাও ব্যয় করা হয়নি। যে সময়ে কিনা গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভ‚ত, সে সময়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং গবেষণার আবশ্যকতা উপলব্ধি করতে না পাড়ার কারণে গবেষণা সম্পন্ন হয় না। বিশ^বিদ্যালয় এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় সীমিত আর্থিক প্রণোদনা এবং অবকাঠামোগত সুযোগসুবিধা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কারণে সঠিকভাবে তা পরিচালিত হয় না। সম্প্রতি ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৫০ বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৫টি ২০২০ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। মাত্র ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে মাত্র ৪৪টি বিশ^বিদ্যালয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী একাধিক পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে সারা বছরে দু-চারটি প্রকাশনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়নি (ইত্তেফাক, জানুয়ারি ৪, ২০২২)। তবে যাদের ভালো ভালো গবেষণা ও প্রকাশনা রয়েছে তাদের মূল্যায়ন করার রীতি প্রচিলিত নেই, যা গবেষণাকর্মকে উৎসাহিত করতে পারত।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক প্রণোদনা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন বা জাপানের মতো বরাদ্দ প্রদান সম্ভব না হলেও যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সেটিও যদি সঠিক পথে এবং উপযুক্ত গবেষকদের দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়' তা হলে গবেষণায় বাংলাদেশ এতটা পিছিয়ে পড়ত না। তাই আর্থিক প্রণোদনা অপেক্ষা সঠিক ব্যক্তির কাছে গবেষণার ভার যাচ্ছে কিনা, সেটাই আমার কাছে বড় সমস্যা বলে মনে হয়। এই দিকটির ওপর অধিক মনোযোগ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন' যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন এবং নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বর্তমান প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও ধারণার জন্ম হবে, সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণালব্ধ সমাধান আসবে; যে কোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশল গ্রহণ করা হবে গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। কী বা কেমন পরিস্থিতি দেশ/বিশ্ববাসীকে সামনে মোকাবিলা করতে হবে, সেটিও উদ্ঘাটিত হবে গবেষণার মাধ্যমে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিশ^বাজারে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে বাংলাদেশের মতো গবেষণাবিমুখ দেশের। পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত শিক্ষা কয়েক বছর পরপর অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পুরানো দক্ষতা বর্তমানের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় সমাজের সব খাতের সুষম ও সমন্বিত বিকাশের জন্য পুনঃপুন গবেষণা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে পরিকল্পনা বা গবেষণার স্বরূপ বোঝা যায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও পরিণতি দেখে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে একটি বিশালাকৃতির ফ্লাইওভার তৈরির কাজ চলেছে প্রায় বছরখানেক। এতে নগরবাসীর কী কষ্ট সেটা ভাবার কারো ফুসরত নেই, সেটা মানতে নগরবাসী বাধ্য, যেহেতু বাংলাদেশের জন্য সেটা খুবই ‘মামুলি’ ব্যাপার। কিন্তু কিছুদিন পর কাজ চলাকালীন সময়ে দেখা গেল ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে জিইসিতে কোনো পকেট ছিল না; পওে সেটা সংযোজন করা হয়েছে; হয়তো বিশেষ কারো সুবিধার বিবেচনায়। এতে কী হলো? ফ্লাইওভার মেরামত হলো; জোড়াতালি হলো। নাগরিকদের কী এলো-গেল; দেশের অর্থের কী সংস্থান হলো' সেটা নিয়ে না হয় আবার পরিকল্পনা করা যাবে! দুবার জোড়াতালির পর দেখা গেল পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না রাখায়, সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরবাসী দোতলা নদী দেখার সুযোগ পায়। এখন যানজট বা জলজটের জন্য কেবল ভাঙা রাস্তাকে এককভাবে দোষারোপ করা হয় না; এখন সড়ক ছাড়াও রাস্তা থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত ফ্লাইওভারেও যানজট ও জলজট ঘটতে পারে।

জাতিকে গবেষণামুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি গবেষকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণার ফলাফলের জন্য যদি গবেষককে ভুগতে হয়, সচিবালয় কিংবা আদালতে যদি হাজিরা দিতে হয়, তা হলে গবেষকরা নিরুৎসাহিত হবেন। গবেষণার গুণগত মান রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট গবেষককেও নির্মোহ, নির্দলীয় ও সৎ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বর্তমানকে ভালোভাবে জানতে হলে এবং ভবিষ্যতে ভালোভাবে বুঝতে হলে অতীত নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করতে হয়। ভবিষ্যতে সমাজ নিয়েও গবেষণা করতে হয়। যে দেশে অতীত ও বর্তমান নিয়ে যত বেশি গবেষণা, সে দেশের ভবিষ্যৎ তত বেশি পরিষ্কার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অপশ্চিমা দেশগুলো যেখানে গবেষণাকর্ম নানাভাবে নিরুৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত, সে সব দেশের পক্ষে গবেষণানির্ভর পশ্চিমা ও উন্নত বিশে^র পরিস্থিতি বা বাস্তবতা অনুভব করতে করতে কেবল দুই থেকে পাঁচ দশক পার হয়ে যায়। ফলে গবেষণানির্ভর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে হাঁটা তো দূরের কথা, অনেক সময় তাদের অনুকরণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এহেন বাস্তবতায় সমাজ বিকাশের চিরায়ত তত্ত¡ যেন বাঙময় হয়ে ওঠে।

অতএব, আমাদের গবেষণায় বেশি বেশি মনোনিবেশ করতে হবে; নিজেকে জানার জন্য, দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গবেষণা ব্যতীত যা কোনোদিন সম্ভব নয়। গবেষণা জ্ঞান তৈরি, সমস্যা অনুধাবন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ব্যবসার প্রসার, মানুষের চাহিদা এবং আচরণ বোঝার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা ও সঠিক-ভ্রান্ত ইতিহাস জানা যায়। এমনকি খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, প্রেম, ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়াদি সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পাওয়ার প্রধানতম উপায় গবেষণা।

লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

Beta version