-->
শিরোনাম

করোনা ও পৃথিবীর ইতিহাসে মহামারি

তালাত মাহমুদ
তালাত মাহমুদ
করোনা ও পৃথিবীর ইতিহাসে মহামারি

ঘাতক ব্যাধি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। বিশ্বের ৮শ’ কোটি আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ আজ বড় অসহায়ত্বের শিকার! সারাবিশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ৩৭ কোটি ৯৬ লাখ। মারা গেছে ৫৭ লাখের বেশি। আশঙ্কাজনক হারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এই ভাইরাসটি প্রথম আবিষ্কৃৃত হয়। তবে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, ২০ হাজার বছর আগেও পৃথিবীতে করোনার অস্তিত্ব ছিল। পৃথিবীর ২০৩টি দেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, স্পেন, ভারত, ইতালি, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি। নতুন করে আক্রান্ত দেশগুলো হলো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আর্জেন্টিনা ও চীন। করোনার পাশাপাশি নতুন ভাইরাস ওমিক্রণ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানিদের ধারণা, প্রথম ঢেউ থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম ঢেউয়ের ধাক্কায় বিশে^র ৫০ কোটি মানুষ করোনা আর ওমিক্রণে আক্রান্ত হবে। মারা যাবে অন্তত এক কোটি মানুষ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রতি একশ’ বছর পরপর পৃথিবীতে মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। আর এই ঘাতক ব্যাধির প্রাদুর্ভাবের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রই পাল্টে গেছে। পৃথিবী সৃষ্টির পর বিশেষ করে মানববসতি গড়ে ওঠার সময় থেকেই কালেকালে ভয়াবহ মহামারি মানব সভ্যতা ও অর্থনীতিকে ওলটপালট করে দিয়েছে। পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এই মহামারি রেকর্ড করা হয়েছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আগ্রাসন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভূমিকম্প, প্লেগ, কলেরা, খরা, দুর্ভিক্ষ তথা বিভিন্ন মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মহামারিতে বিশ বারবার আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে কোটি কোটি মানুষ। ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি শতাব্দীর ২০ খ্রিস্টাব্দেই নানা ধরনের ঘাতক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।

১৩২০ খ্রিস্টাব্দে দ্য ব্ল্যাক ডেথ অব বুবোনিক ব্যাধিতে ২শ’ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে দ্য এওইডেমিক অব ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ (দ্বিতীয় প্লেগ প্রলয়) মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে ১৪শ’ শতাব্দিতে বিশে^র মোট জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৭৫ মিলিয়নে নেমে এসেছিল। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে বিশব্যাপী গুটি বসন্ত ও প্লেগ মহামারি হানা দেয়। এতে আক্রান্ত হয়ে ৫ কোটি ৬০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে মহামারির প্রলয়ে গোটা বিশ^ই যেন মুর্চ্ছা যায় রক্তিম ‘মে ফ্লাওয়ার’ ভাইরাসের ফলে বিশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্শেই’ মানব জাতির ওপর হামলে পড়ে। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, এই শতকে দুনিয়াজুড়ে শুধু প্লেগ রোগেই ২০ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে কলেরা, যুক্তরাষ্ট্রে ইয়োলো ফিভার মহামারি দেখা দেয়। ভারতবর্ষ থেকে ব্যাংকক, মেনিলা, ইরান, বাগদাদ, সিরিয়া হয়ে জানজিবার পর্যন্ত, আর আফ্রিকা ইউরোপে বসন্ত রোগে মারা যায় ৬ কোটি মানুষ। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্য স্প্যানিশ ফ্লু’তে পৃথিবীতে ১শ’ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই মহামারি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

২০২০ খ্রিস্টাব্দে সারাবিশে এ প্রতিবেদন তৈরির মুহূর্ত পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১৯ কোটি ৯৬ লাখ। মারা গেছে ৪২ লাখ ৪৯ হাজার। সবচেয়ে ভযাবহ অবস্থায় আছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, স্পেন, রাশিয়া ও ভারত। বাংলাদেশে ৩ আগস্ট প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১২ লাখ ৯৬ হাজার। মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ৩৯৭ জনের। বাংলাদেশে কঠোর লকডাউন চললেও মানুষের মাঝে আতঙ্কের মাত্রা ছিল কম।

সুদূর অতীতে মহামারি সংঘটিত হয়েছে দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক। চিকিৎসা চলেছে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে। ঝাড়, ফুঁক, টোটকা ইত্যাদি অপ-চিকিৎসায় অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ডায়রিয়া বা কলেরা হলে রোগীকে পানি পান করতে দেওয়া হতো না। ফলে পানি শূন্যতায় অধিকাংশ রোগীর মৃত্যু হতো। এক অঞ্চলে মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আতঙ্কিত মানুষ অন্য অঞ্চলে বা অন্য দেশে চলে যেত। কিন্তু এই অত্যাধুনিক যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের যুগে করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এমন সর্বগ্রাসী মহামারি অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। এই মহামারি ভাইরাসের প্রতিকারের জন্য আজ পর্যন্ত ফলপ্রসূ বেশকিছু প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় শুরু থেকেই চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ মহল চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য বিপজ্জনক। আমাদের আরো সাবধান হতে হবে, আরো সচেতন হতে হবে। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে সারাবিশ্বে উদ্বেগ বাড়ছে। করোনার ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ মারাত্মক রূপ ধারণ করায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিটি মহামারির সাথে পরবর্তী মহামারির শুধু একই ধারাবাহিক সময় চক্রের সাথে নয়, মিল রয়েছে সংক্রমিত ব্যাধির ক্ষেত্রেও। যার ধারাবাহিকতায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের স্প্যানিশ ফ্লু’র পর জ¦রগ্রস্তের মতো আরো একটি ব্যাধি নোবেল করোনাভাইরাসের (কোভিডÑ১৯) মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটল ২০২০ খ্রিস্টাব্দে। নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে বিশে^র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পথে এগোতে থাকে। শুরুতে প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা সংস্থা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করেছে। কয়েকটি ভ্যাকসিন থেকে আশা জাগানিয়া ফলও পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে যেসব দেশের টিকা এসেছে সেগুলো হলো কফিসিল্ড (ভারত), সিনোফার্ম (চীন), অ্যাস্ট্রাজেনেকা (জাপান), স্পুটেনিক (রাশিয়া) এবং মডার্না (যুক্তরাষ্ট্র)।

করোনা ও ওমিক্রন সংক্রমণ নিয়ে সারাবিশে উদ্বেগ বাড়ছে। করোনা ডেল্টার পর বর্তমান ওমিক্রনের সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) মানুষকে সচেতন করতে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার জন্য নির্দেশাবলিগুলো হলো ক. ওজন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। খ. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন সবুজ শাকসবজি, লেবু, কমলা ইত্যাদি। গ. ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ। যেমন দুধ, ডিম, কলিজা, সামুদ্রিক মাছের তেল ইত্যাদি। ঘ. গরম পানিতে লেবু, আদা, মধু মিশিয়ে সেবন এবং বেশি বেশি পানি পান করা। ঙ. সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া। চ. নিজেকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রাখা। ছ. ঘরে বসেই নামাজ আদায়, প্রার্থনা করা। জ. সহনীয় মাত্রায় শরীর চর্চা করা। ঝ. নিয়মিত রোজা রাখা, উপবাস ব্রত পালন করা। ঞ. ঠান্ডা লাগানো যাবে না। ঠান্ডা খাবার বিশেষ করে আইসক্রিম খাওয়া যাবে না। ট. দূরত্ব বজায় রাখা। ঠ. নাক মুখ স্পর্শ না করা। ড. কাশির সময় সাবধানতা। ঢ. ভ্রমণে সতর্কতা। ণ. অভ্যর্থনায় সতর্কতা ইত্যাদি।

সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, ‘ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে চূড়া ছুঁতে পারে সংক্রমণ’। বলা হয়েছে, ‘করোনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল গত বছরের জুলাইয়ে। সে মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬। গড়ে দৈনিক শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৮৪৬ জন করে। অথচ নতুন বছরের ২২-২৬ জানুয়ারি ৫ দিনেই ছাড়িয়ে গেছে সে মাসের দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা। এই ক’দিনে শনাক্ত হয়েছে ৬৬ হাজার ৯০৮ জন এবং দৈনিক গড় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৩৮২। পত্রিকাটির হিসাব মতে, বর্তমান গতিতে রোগীর সংখ্যা শনাক্ত হতে থাকলে দু’দিনের ব্যবধানে রোগীর সংখ্যা হবে প্রায় এক লাখ এবং দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ হাজার ২৮৬। জানুয়ারির শুরু থেকে যে হারে রোগী শনাক্ত বাড়ছে, তাতে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ নাগাদ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সোয়া দুই গুণ থেকে আড়াই গুণ অর্থাৎ সর্বোচ্চ আড়াই লাখ হতে পারে। কারণ জানুয়ারি মাসের প্রথম ৭ দিনের তুলনায় শেষ ৫ দিনে রোগী বেড়েছে ১৭ গুণ।

ঘরে ঘরে জ¦র সর্দি কাঁশি। আবালবৃদ্ধবনিতা এই ভাইরাস জ¦রে আক্রান্ত। ধারণা করা হচ্ছে, এ বালাইয়ের সাথে ওমিক্রনের বিস্তার ঘটছে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। আবার মাসব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা চলছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় জেলায় মেলা চলছে। আতুর ঘরের শিশু থেকে সব বয়েসির নারী-পুরুষ রাত ১২টা অব্দি মেলায় অযথা ঘোরাফিরা করছে। অথচ তাদের মুখে মাস্ক নেই। শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে এমন চিত্র কারো বিবেককেই নাড়া দেয় না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। পৃথিবী যাতে জনশূন্য না হয়, সেজন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা আমাদের কৃত অপকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

লেখক: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, কবি সংঘ বাংলাদেশ

মন্তব্য

Beta version