-->
শিরোনাম

স্বাধীনতার ৫০ বছরে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব

প্রফেসর ড. মো. নাসিরউদ্দীন মিতুল
প্রফেসর ড. মো. নাসিরউদ্দীন মিতুল
স্বাধীনতার ৫০ বছরে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব

“... শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসারের মাধ্যমেই উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং এর বাইরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আর কোনো রহস্য নাই।” উক্তিটি ২০০৪ সালে এলহানন হেল্পম্যান নামক একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ তার ‘দ্য মিস্ট্রি অব ইকোনমিক গ্রোথ’-এ বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রমাণ করেন। এরপর অবশ্য ১৮৭২ সালে জাপান সংস্কারের অন্যতম নেতা কিদো তাকায়োমি ‘শিক্ষার মৌলিক বিধান’ (ফান্ডামেন্টাল কোড অব এডুকেশন) রচনাকালে এক ঘোষণায় বলেন, ‘কোনো জনসমষ্টিতে একজন মানুষও নিরক্ষর থাকলে সেখানে উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ অতএব শিক্ষা হচ্ছে সকল উন্নয়নের নিয়ামক শক্তি। সবকিছুর উন্নতি হচ্ছে অথচ শিক্ষা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে যারা এমন ভাবধারা পোষণ করেন, তারা স্ববিরোধী। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হলে গ্রন্থাগার হচ্ছে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হৃৎপিণ্ড স্বরূপ।

জাতীয় জীবনে গ্রন্থাগারের ভ‚মিকা অপরিসীম। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এর কোনো বিকল্প নেই। গ্রন্থাগার হচ্ছে একটি জীবন্ত উপকরণ, যা সর্বকালের সভ্যতার মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করে। এটি এমনই একটি প্রতিষ্ঠান যা অতীতে সকল তথ্য সংরক্ষণ করে বর্তমান প্রজন্মের নিকট ব্যবহারের জন্য তুলে ধরে এবং অতীত ও বর্তমান কালের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করে সংরক্ষিত তথ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করে। গতকাল ৫ ফেব্রæয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস-২০২২’ পালিত হলো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার’ ডিজিটাল গ্রন্থাগার’। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতিসহ বাংলাদেশের সব গ্রন্থাগার পেশাজীবীরা এ দিনটি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করেছেন। বিগত কয়েক বছর গ্রন্থাগারের গুরুত্ব তুলে ধরতে সচেষ্ট গ্রন্থাগার পেশাজীবীরা। বিষয়টি সরকারের নজরে আনতে চলে নানা কর্মতৎপরতা। আর এ কাজে নেতৃত্ব দেন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। সঙ্গে যুক্ত হন ঢাকাস্থ ব্রিটিশ কাউন্সিল, বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতি ও নানা পেশাজীবী সংগঠনসমূহ। দাবির সপক্ষে আন্দোলন করেন প্রতিটি পেশাজীবী। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৫ ফেব্রæয়ারি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসেবে পালনের স্বীকৃতি প্রদান করেন। ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি প্রথম বাংলাদেশে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস-২০১৯’ পালিত হয়। এবার চতুর্থবারের মতো পালিত হয়েছে দিবসটি।

প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ৫ ফেব্রুয়ারি কেন? অবগতির জন্য বলছি’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে তৎকালীন যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য থাকাকালীন বছরের এই দিনটিতে প্রথম পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দিনটি গ্রন্থাগার আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। তাই এ দিনটি ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতিদানের মাধ্যামে গ্রন্থাগারবান্ধব প্রধানমন্ত্রী সব গ্রন্থাগার পেশাজীবীর আত্মমর্যাদা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিলেন।

এ বছর জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালনের প্রেক্ষাপট বিগত বছরগুলো থেকে আলাদা। এর তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, দ্বিতীয়টি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও তৃতীয়টি বিশময় করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা। একদিকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজন। এ উদ্যোগকে আরো ত্বরান্বিত করেছে ইউনেস্কো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনে ইউনেস্কোর আনুষ্ঠানিক এ উদ্যোগ বিশ্বময় সবাইকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে। অন্যদিকে মাত্র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে যারা কটাক্ষ করেছে, তারা প্রত্যক্ষ করছে এ বীর জাতি কিভাবে মাথা উঁচু করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক রোল মডেল। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের দৃশ্যমান এক বাস্তবতা। তা ছাড়া এমন শত সফলতা প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে।

করোনাকালের এমন পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’-এর প্রতিপাদ্য মনে করিয়ে দেয় বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো কম্পিউটার এবং উন্নততর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। এটি একটি যুগোপযোগী, কিছুটা ব্যাপকভিত্তিক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে ই-গভর্নেন্স, ই-কৃষি, ই-স্বাস্থ্য, ই-বাণিজ্য, ই-ভ‚মিমালিকানা, ই-শিক্ষাসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক সেবা নিশ্চিত করাই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। বর্তমান সরকার তার ক্ষমতাগ্রহণের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করবে। কথা রেখেছে সরকার। সেদিন যারা বিষয়টিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সরকারকে নানাভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছিল, আজ তারাই এর শতভাগ সুবিধাভোগী। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর ‘রূপকল্প ২০২১’ নয়। এটি এখন নিত্যদিনের দৃশ্যমান এক বাস্তবতা। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাইজেশন করার উদ্দেশ্যে প্রায় প্রতিটি স্কুলে চালু করা হয়েছে আইসিটি ল্যাব। কম্পিউটার কোর্সকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার লক্ষ্যে ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রয়াসে স্কুলভিত্তিক আইসিটি মেলা ও বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ এক না হলেও এটুকু মানতেই হবে যে করোনাকালীন ফেস-টু-ফেস ক্লাসের পরিপূরক হচ্ছে অনলাইন ক্লাস। ইউনেস্কো দূরশিক্ষণ পদ্ধতিকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। আর অপ্রিয় হলেও সত্যি, প্যান্ডেমিক অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবতাকে ত্বরান্বিত করেছে। তাই এর কোনো বিকল্প নেই। চ্যালেঞ্জ থাকবেই। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। উচ্চশিক্ষা তো এখন বিশ^জুড়ে অপেরা, গুগোল ক্লাসরুম, জুম, ইউটিউব, গুগোলমেট, মাইক্রোসফট প্লাগ, অফিস থ্রি-সিক্সটি-ফাইভ ইত্যাদি সফটওয়্যার-নির্ভর হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি লাইব্রেরির কার্যক্রম চলছে অনলাইনে। যদিও দেশের সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ সুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। তথাপিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে তথ্যের বিভিন্ন উৎসসমূহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার একাধিক প্ল্যাটফর্ম দেশে তৈরি হয়েছে। এটিই ডিজিটাল লাইব্রেরির সারকথা। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে অতি সহজেই তার প্রয়োজনীয় রেফারেন্স সামগ্রী যেমন জার্নাল, প্রবন্ধ, বই, পত্রিকা, ছবি বা ইমেজ, অডিও এবং ভিডিও ফাইল খুঁজে পাচ্ছে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খ্যাতনামা অনেক প্রকাশক থেকে ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে পাঠ্যসামগ্রী সাবস্ক্রাইব করে তাদের নিজেদের শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের ইউজিসি এ কাজে পৃথিবীর বিখ্যাত প্রকাশকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্বল্পমূল্যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ই-বুক, ই-জার্নাল ইত্যাদি সরবরাহ করছে। উদ্যোগটি মহৎ।

শিক্ষা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হলে গ্রন্থাগার সেই হাতিয়ারের ট্রিগার। বঙ্গবন্ধু গ্রন্থাগারের গুরুত্ব সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে অনুধাবন করতে পেরে ১৯৭৩ সালে গৃহীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রন্থাগারের উন্নয়নে দুই কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। অতএব জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে গ্রন্থাগারের কোনো বিকল্প নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায় শিক্ষার মান বাড়াতে দরকার মানসম্পন্ন গ্রন্থাগার। করোনাকালে ডিজিটাল লাইব্রেরি হয়ে উঠতে পারে শিক্ষার এক নতুন আলোকবর্তিকা। আর দেশে ছোট বড় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ৪৬ হাজার গ্রন্থাগার পেশাজীবী সেই জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। যাদের নিরলস প্রচেষ্টা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে, দেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করতে' এমনকি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলা করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছে। সেই অর্থে এবারের প্রতিপাদ্য' ‘সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার, ডিজিটাল গ্রন্থাগার’ যথার্থ বলেই আমি মনে করি।

জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হলো। এখন এ নিয়ে আমাদের ব্যাপক কাজ করা দরকার। স্কুল লাইব্রেরিগুলোকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও যে পড়াশোনার বিশাল জগত আছে, তা শিক্ষার্থীদের অনুধাবনের সুযোগ করে দিতে হবে। স্কুল লাইব্রেরিতে কোমলমতি শিশুদের পড়ার জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকরা কেবল বিশাল জ্ঞানজগতের পথ দেখিয়ে দিতে পারেন মাত্র। সেখানে বিচরণ করতে হবে শিক্ষার্থীদেরই। জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতিটা তারা বাতলে দেবেন। তাদের জ্ঞানার্জনে ও স্বশিক্ষিত হতে উৎসাহিত করবেন। শিক্ষার্থীদের স্কুল লাইব্রেরিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ লাইব্রেরিতে নিয়ে যাবেন। হাতেকলমে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করা শেখাবেন। এরপর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অভিরুচি ও আগ্রহ অনুযায়ী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও মধ্যবয়স্ক সবার জন্য বই পড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা উচিত। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যেসব গ্রন্থাগার আছে, তা আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে লাইব্রেরি। বই শুধু শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়, বই পড়ার অভ্যেস ও চর্চা আমাদের করতে হবে নিরন্তর ও পারিবারিকভাবেও। তবেই গ্রন্থাগার আন্দোলন সার্থক হবে।

লেখক : ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য

Beta version