কয়েকদিন আগেকার সংবাদ- ‘জলাশয় ভরাট করে পাঁচ তারকা হোটেলের অনুমতি রেলের’। সংবাদ মারফত জানা যায়, আইন অমান্য করে রাজধানীর কুড়িলে জলাশয় ভরাটের অনুমতি দেয় খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ! সেখানে একটি পাঁচ তারকা হোটেলের নির্মাণ শুরু হয়েছিল। খবর পেয়ে মেয়র আতিকুল ইসলামের নির্দেশনায় জলাশয় ভরাট বন্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালায় ডিএনসিসি। শেষমেশ নির্মাণকাজ বন্ধ করা গেলেও ‘কেন জলাশয় ভরাট করে হোটেল নির্মাণের অনুমতি দেয়া হলো’' এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
‘জলাধার সংরক্ষণ আইন’- এর ৩৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো জলাশয়, খাল, লেক ভরাট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও এটা নিষিদ্ধ। তবে এই আইনকে তোয়াক্কা করছে না দখলদারেরা। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দশ বছরে ভরাট হয়েছে ঢাকার ৩৬ শতাংশ জলাশয়। রাজধানীর আশপাশে সাভার, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও গাজীপুরেও অস্তিত্ব হারিয়েছে এক লাখ একরের বেশি জলাশয়। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও আবাসন কোম্পানি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে নদী ও জলাশয় দখলদার ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। তাদের মধ্যে ঢাকারই আট হাজার ৮৯০ জন! বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে ঢাকা ও এর চারপাশের জলাশয় ভরাট হয়েছে ১ লাখ ৯৩৭ একর। ঢাকা মহানগরীতেই ভরাট হয়েছে ৯ হাজার ৫৫৬ একর। কেরানীগঞ্জে ২৬ হাজার ৪৭৪, রূপগঞ্জে ১৬ হাজার ৫৪২, গাজীপুরে ১৩ হাজার ৮৪২ একর এবং সাভারে ২০ হাজার ৬৩৮ একর জলাশয় অস্তিত্ব হারিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বার বার সতর্ক করছেন' জলাভ‚মির এ দখলদারিত্ব এখনই ঠেকানো না গেলে পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে সবাইকে।
বাংলাদেশ ‘নদীমাতৃক’ দেশ। বাংলাদেশ মানেই শত-সহস্র নদী। ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ণ জলাভ‚মির উন্মত্ত জলরাশি। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর। দেশটির বুক চিরে বয়ে গেছে ছোট-বড় অগণিত জলাধার। জলধারার প্রাকৃতিক স্পর্শে এদেশের মাটি পেয়েছে উর্বরতা, পরিবেশ হয়েছে বৈচিত্র্যময়। উর্বর মাটির বৈচিত্র্যময় পরিবেশে এই ব-দ্বীপ হয়ে উঠেছে বিচিত্র জীবনের আধার। বাংলার কাদা-জলের অনুক‚ল আলিঙ্গনে গড়ে ওঠা বাস্তুসংস্থান যুগ যুগ ধরে বৈচিত্র্য ছড়িয়ে চলেছে। এদেশের সুবিশাল জলাভ‚মির জীববৈচিত্র্য আবহমানকাল ধরে একটু বেশিই প্রাণবন্ত। সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ মূলত বিচিত্র জলাভ‚মির দান। প্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই জলাভ‚মি রয়েছে। তবে, জলাভ‚মির প্রশ্নে বাংলাদেশ একটু বেশিই আশীর্বাদপুষ্ট। অথচ, দেশের মাটি ও প্রাণ তথা জীববৈচিত্র্যর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনা এ জলাভ‚মির প্রতি আমরা উদাসীন! দিন দিন বিলীন হতে চলা বাংলার বিস্তীর্ণ জলাভ‚মির সংরক্ষণে আমরা ততটা আন্তরিক নয়! বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকে। কাজেই, জলাভ‚মির সংরক্ষণে গুরুত্বারোপ বাংলাদেশের জন্য দিন দিন অবধারিত হয়ে উঠছে। জলাভ‚মি কিংবা জীববৈচিত্র্যের প্রশ্নে বিশ্ব আজ অনেক বেশি সজাগ। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশশ্ব জলাভ‚মি দিবস’কে এখন বিশ্বব্যাপী শতভাগ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
এবারও গত ২ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব জলাভ‚মি দিবস’ পালিত হলো। জলাভ‚মির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী সম্মেলনে জলাভ‚মির টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই হয়। এটি ‘রামসার কনভেনশন চুক্তি’ নামে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে রামসার কনভেনশন চুক্তি কার্যকর হয়। পৃথিবীর জলাভ‚মিগুলোর গুরুত্ব এবং এর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এবং উন্নয়নধারাকে বিবেচনা করে প্রতিটি বছরের জন্য এক একটি প্রতিপাদ্য তৈরি হয়। ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য- ‘মানুষ ও প্রকৃতির জন্য জলাভ‚মি’। সত্যি, প্রকৃতি ও মানুষকে রক্ষা করা হলে আগে জলাভ‚মি রক্ষা করতে হবে।
নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভ‚মি নদীবিধৌত বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে বহুযুগ ধরে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, এ দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভ‚মি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। হিসাব অনুযায়ী, জলাভ‚মি দেশের মোট আয়তনের প্রায় অর্ধেক। এ সুবিশাল জলাভ‚মি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে এ দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হলো হাওর অঞ্চল ও সুন্দরবন। শুধু সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত সাইক্লোনের হাত থেকে এ দেশ বাঁচানো এক অতন্দ্রপ্রহরী হলো সুন্দরবন। এ ছাড়া আড়িয়াল বিল ও চলনবিল এ দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ জলাভ‚মি। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আরেক নিদর্শন হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ৩৭৩টির বেশি হাওর রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রাণ এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি তথা নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়ের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। জীববৈচিত্র্যসহ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য দেশের এ বিস্তীর্ণ জলাভ‚মির ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। হাওর ও জলাভ‚মি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, হাওরাঞ্চলে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়। সাংবিধানিকভাবেও এর গুরুত্ব স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
বিগত কয়েক দশকে দেশের শহর, নগর ও মহানগরগুলো অত্যন্ত দ্রুতগতিতে জলাভ‚মি হারিয়েছে। জলাশয় ভরাট করে অট্টালিকা গড়ে তোলা হয়েছে। খাল ভরাট করে ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে। ছোট-মাঝারি জলাশয়গুলো বিলীন হয়েছে পার্ক, শপিংমল কিংবা বাজার-ঘাট নির্মাণের কারণে। পরিসংখ্যান মতে, নগর এলাকায় কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় দরকার হলেও ঢাকায় আছে ৪ শতাংশেরও কম। জলাভ‚মি ধ্বংসের করুণ চিত্রের বাস্তবতা ধরা পড়ে রাজধানী ঢাকার দিকে দৃষ্টি দিলে। ঢাকাকে একসময় বলা হতো ‘২৬ খালের শহর’। কোথায় গেল সেই খালগুলো? অধিকাংশ খালেরই বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই। যে দু’একটি টিকে আছে সেগুলো নিতান্তই রুগ্ণ। ঢাকার পরিচিতি ‘বুড়িগঙ্গার তীরের শহর’ হিসেবে। অথচ, ঢাকার ‘প্রাণ’ সেই বুড়িগঙ্গা নদীরই-বা বর্তমান অবস্থা কি? মারাত্মক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে একসময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গাকে। সম্প্রতি মহামান্য আদালত বুড়িগঙ্গাকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে এর রক্ষণাবেক্ষণে নির্দেশনা জারি করেছেন। তারপরও অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।
জলাভ‚মিকে বলা হয় ‘প্রকৃতির কিডনি’। স্বভাবতই প্রাণ ও প্রকৃতির অন্যতম নিয়ামক মাটি ও জল। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ বিষয়ে আমাদের খুব একটা ভাবান্তর নেই! প্রতিনিয়ত আমরা এক একটা জলাভ‚মির পেট চিরে এক একটা ইমারত গড়ে তুলছি! পত্রপত্রিকার পাতাজুড়ে জলাভ‚মি দখল করে সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণের খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে প্রতিনিয়তই। জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এসব নিয়ে আমাদের অতিসত্বর ভাবতে হবে। ব্যক্তিসচেতনতার সাথে সাথে সরকারি-বেসরকারি প্রচার বাড়াতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের মনে রাখতে হবে- জলাভ‚মির ধ্বংস প্রকৃতি ও জীবন ধ্বংসেরই নামান্তর। আশার কথা হলো, দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপদ করতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি এবং বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়ন করছে। তাছাড়া জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ জলাভ‚মি উন্নয়নে সরকারের ২০১২ থেকে ৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। এসব প্রকল্পে গতি সঞ্চারিত হোক। পরিবেশসচেতন নাগরিকদের উচিত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে বাঁচতে হলে জলাভ‚মি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রকৃতি ও প্রাণের অস্তিত্বের প্রশ্নে জলাভ‚মির সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকার পাক’ এটাই আমাদের একান্ত কাম্য।
লেখক: সাংবাদিক।
মন্তব্য