নিত্যপণ্যের বাড়তি মূল্য, লাগাম টেনে ধরার এখনই সময়

শফিক আহমদ শফি
শফিক আহমদ শফি
নিত্যপণ্যের বাড়তি মূল্য, লাগাম 
টেনে ধরার এখনই সময়

শীত মৌসুমেও দেশের নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের লাগাম টেনে ধরা মুশকিল হয়ে পড়েছে। ফলে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। সিলেটে শুধু শীতকালীন সবজির দাম বেড়েছে এমনই নয়; একইসাথে দাম বেড়েছে ডাল ও ভোজ্যতেলের। গরুর মাংস, ডিম ও মুরগি দামও বৃদ্ধি পেয়েছে পাল্লা দিয়ে।

যেহেতু আমি সিলেটে থাকি, তাই আগে সিলেটের বাজারের বর্ণনা দেওয়া যাক। সিলেট নগরীর বন্দরবাজার, আম্বরখানা, সোবহানীঘাট ও সুবিদবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। প্রতিকেজি সবজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা দাম বেড়েছে। এসব বাজারে প্রতিকেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা, শিম বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, বেগুন ৪০-৬০ টাকা, ফুলকপি প্রতিপিস ৩০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, গাঁজর প্রতিকেজি ৪০ টাকা, কুমড়া পিস ৫০ টাকা, প্রতিপিস লাউ আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়, মিষ্টি কুমড়ার কেজি ৫০-৭০ টাকা, মুলা ৩০ টাকা, পেঁপে ৩০-৪০ টাকা কেজি, কাঁচামরিচ প্রতিকেজি ৮০ টাকা, শসা ৪০ টাকা কেজি ও লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। বাজারে চায়না রসুন প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা। দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি। দেশি আদার কেজি ৬০ টাকা। চায়না আদার দাম কমে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে ডাল। ইন্ডিয়ান ডালের কেজি ১০০ টাকা। গত সপ্তাহে ইন্ডিয়ান ডাল প্রতিকেজি বিক্রি হয় ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। দেশি ডালের কেজি ১২০ টাকা। বাজারে ভোজ্যতেলের লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকা। প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। এছাড়া প্যাকেট চিনি কেজি ৮৫ টাকায় ও আটা প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। বাজারে বেড়েছে ডিমের দাম। লাল ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়। হাঁসের ডিমের ডজন বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৯৫ টাকা। দেশি মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা। সোনালি (কক) মুরগির ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। বাজারে বেড়েছে মুরগির দাম। ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা। গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ২৩০ টাকা কেজি।

এ চিত্র শুধু সিলেটের নয়, এ রকমই দেশের প্রতিটি বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলার বাজারেও বিরাজ করছে। রাজধানী ঢাকার অবস্থা আরো সঙিন। যারা সেখানে বসবাস করেন, তারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে কী যে দুসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে আছেন, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। প্রতিদিনকার নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি যেন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দেশের একটি বিশাল অংশই সাধারণ মানুষ। আর এ সাধারণ মানুষই বর্তমানে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। করোনা মহামারির ভয়াবহ ছোবলে অনেকেই পথে বসেছেন, নিঃস্ব হয়েছেন, চাকরি হারিয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন। দুইবেলা পেটপুরে খাওয়ার পয়সাও অনেকের জুটছে না। অনেকে তার একমাত্র উপার্জনক্ষম প্রিয় মানুষকেও হারিয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন-বিপর্যস্ত। ওলট-পালট করে দিয়েছে তাদের সহজভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। মহামারির এ পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে উদিত হচ্ছে নানা সমস্যা, বাড়ছে দুর্ভোগ-ভোগান্তি আর বাড়তি চাপের বোঝা।

আমাদের বেঁচে থাকার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা অপরিসীম। অথচ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাজারে দাম বৃদ্ধি পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এ দাম বৃদ্ধির একটা মাত্রা তো অবশ্যই থাকা উচিত। কোনো জিনিসের দাম বৃদ্ধির আগে দেখতে হবে মানুষের ক্ষমতা বা সাধ্য। দেশের একটি বিশাল সংখ্যার মানুষ দিন এনে দিন খায়। রয়েছে নিম্নআয়ের অসংখ্য মানুষ। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের কথাও এ ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া যাবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যখন-তখন ইচ্ছামতো বৃদ্ধি করলে এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলে তা সবার জন্যই কষ্টকর। আমাদের দেশের বাজারগুলোয় জিনিসপত্রের দাম খুব সহজেই লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে বেড়ায়।

করোনা পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতে না দিতেই সাধারণ মানুষকে আবার মুখোমুখি হতে হলো নতুন একটি সমস্যারÑ গণপরিবহণে বাড়তি ভাড়া আদায়। পরিবহণ শ্রমিক-মালিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার ডিজেলচালিত পরিবহণের ভাড়া বাড়িয়েছে। বর্তমানে সাধারণ মানুষের জন্য পরিবহণের এ বাড়তি ভাড়া বহন করা নিঃসন্দেহে অনেক কষ্টকর। এটা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। দেখা গেছে, সরকার ডিজেলচালিত পরিবহণে ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দিলেও সব ধরনের পরিবহণেই বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ধিত হারের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করা হচ্ছে দশ টাকাÑ সেটি যত কাছাকাছি দূরত্বই হোক না কেন! সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করা বা ভেবে দেখার কি কেউ নেই?

দেশ উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের গর্ব ও অহঙ্কার। কিন্তু এ দেশের জনগণ, বিশেষ করে যারা সাধারণ মানুষÑ তাদের বাদ দিয়ে, সুযোগ-সুবিধা ও সমস্যার কথা চিন্তা না করে সত্যিকার উন্নয়ন কি সম্ভব? জনগণের উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন। তাই জনগণকে সুবিধাবঞ্চিত করে, তাদের কষ্ট লাঘব না করে উন্নয়ন কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের এ দরিদ্র দেশটি আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বিশ্বসমাজে আজ আমাদের দেশটির পরিচিতি ও প্রশংসায় আমরা গর্বিত হই। বুক ফুলিয়ে ভিনদেশিদের কাছে এখন বলতে পারি আমাদের দেশের কথা। এ কারণেই দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কথা রাষ্ট্রকে অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে কোনোভাবেই সমস্যার মুখে ফেলা যাবে না। অর্থনৈতিক কিংবা যে কোনো চাপে তারা যেন কোনোভাবে জর্জরিত না হন, এদিকে রাষ্ট্রকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। তা ছাড়া বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অশুভ শক্তিশালী চক্রকে প্রতিহত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি পরিবহণের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে রাষ্ট্রকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এদিকে পবিত্র মাহে রমজান আসন্ন। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে রমজানের আগেভাগে। তারপর রমজানে লোকদেখানো দাম কিছুটা কমানো হয় বটে। কিন্তু যে দাম বাড়ে, কমে তার চেয়ে অনেক কম। এভাবে বর্ধিত দাম দিয়েই মানুষকে বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করতে হয়। এটা একটা নতুন চালাকি ও অসাধু প্রবণতা। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সরকার এই চালাকি বুঝতে পারলেও তেমন কিছু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কে কতটা কমাবে, কে কতটা ছাড় দেবে তার প্রতিযোগিতা চলে। বাংলাদেশে তার উল্টো পরিস্থিতি বিরাজ করে। অথচ ১১ মাসের চেয়ে রমজান মাসেই বেশি আমাদের ধার্মিকতা বেড়ে যায়। লোক দেখানো আমল আল্লাহ তায়ালাও পছন্দ করেন না। অন্তরের অন্তস্থল থেকেই আমাদের আল্লাহ, রাসুল ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তাকওয়া অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করে চলতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের সাধারণ মানুষ এখনো অসহায়। স্বাধীনতার এ অর্জন তাদের কাছে মনে হয় বেমানান। নীরবে সব কষ্ট ও অসহায়ত্ব তারা মেনে নিতে বাধ্য হন। একশ্রেণির প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ জনগণ। এক শ্রেণির লোক ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছে আর গরিব আরো গরিব হচ্ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের এসব সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি বাঁচাতে পারে দেশের জনসাধারণকে, ভেঙে দিতে পারে সব সিন্ডিকেট, ফিরিয়ে আনতে পারে সমৃদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

মন্তব্য