-->
শিরোনাম

করোনাকালেও বাজারে অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর খাবার : জনস্বাস্থ্য হুমকিস্বরূপ

সৈয়দ ফারুক হোসেন
সৈয়দ ফারুক হোসেন
করোনাকালেও বাজারে অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর খাবার : জনস্বাস্থ্য হুমকিস্বরূপ
সৈয়দ ফারুক হোসেন

কেমিক্যালযুক্ত, বিষাক্ত, মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন খাদ্য মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বণ্টন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তথাপি উৎপাদনকারী-প্রস্তুতকারীরা বাড়তি মুনাফার লোভে খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছেন। ফলে ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব। সরকার খাদ্য নিরাপদ করতে যেসব আইনের প্র্রয়োগ ও সচেতনতার প্রচার করছে, সেগুলো তারা ভ্রুক্ষেপ করছে না। তাই উৎপাদক থেকে ভোক্তা সবাইকে নিরাপদ ও পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। মাঠে উৎপাদিত ফসল কিংবা পুকুরের তাজা মাছ কিনে আনলেও ভোক্তার টেবিলে যেতে যে কোনো পর্যায়ে সেটা অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যেসব খাবার তৈরি ও বিক্রি হয় তা বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়, বরং তাতে রয়েছে ভয়ঙ্কর জীবাণু। যার কারণে ভয়াবহ হুমকিতে রয়েছে জনস্বাস্থ্য। প্রায় ৯০ শতাংশ খাবারেই রয়েছে এ ভয়ঙ্কর জীবাণু। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে খাদ্যদ্রব্যে রসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকাসহ সারাদেশের ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারেই ই- কোলাই, সালমোনেলা ও ইস্টমোল্ডের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকার হোটেলগুলোয় এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব খাদ্য তালিকার মধ্যে রয়েছে ভাত, মাছ-মাংস, সিঙ্গারা, রুটি, বার্গার, শিক কাবাব, হালিম, ফুচকাসহ নানা ধরনের খাবার। এসব খাবার খেয়ে শিশুসহ সাধারণ জনগণ পেটের পীড়াসহ নানা রোগে ভুগছেন।

রাস্তার ধারে বানানো হচ্ছে রুটি, পাশেই বিভিন্ন পাত্রে খোলা অবস্থায় রাখা হয়েছে ভাত-তরকারি। পানির ড্রামও রয়েছে মুখ খোলা অবস্থায়। মহামারীতে সামাজিক দূরত্ব না মেনেই খেতে বসছেন ক্রেতারা। রেলগেট, বাসস্ট্যান্ড, অফিস-আদালতের সামনের এলাকায়, ব্যস্ত রাস্তার ধারে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করছে ভাজাপোড়া। সেখানেও খোলা অবস্থায় বিক্রি করা হচ্ছে বার্গার নুডলস, হালিমসহ বিভিন্ন খাদ্য। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর ও বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা দূষিত আচার, ঝালমুড়ি, পাপড়, ফুচকাসহ হরেক পদের খাবার নামের অখাদ্য দেদার বিক্রি হচ্ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে অসংখ্য শিশু-কিশোর বিনাবাধায় এসব নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর খাবার কিনে খাচ্ছে। এমনকি মা-বাবারাও শিশুদের এসব খাবার কিনে দেন এবং নিজেরাও খান। উন্নত দেশের স্ট্রিট ফুড স্বাস্থ্যসম্মত, উপাদেয় ও আকর্ষণীয় হয়। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে যেসব খাবার তৈরি ও বিক্রি হয় তা বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। খেতে উপাদেয় বা মুখরোচক হলেও এসব খাবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত এবং পরিবেশিত হয় বলে বিভিন্ন জটিল ও মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। ঢাকার প্রায় সব খাবারের দোকানে খাবার খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত অবস্থায় তৈরি, বিক্রি ও সাজিয়ে রাখা হয়।

তাই এসব খাবার পোকামাকড়-মাছি দ্বারা দূষিত হয়। সাধারণত সস্তা, তৈলাক্ত ও ঝাল হওয়ার কারণে এসব খাবারের বেশ কদর রয়েছে। এ জাতীয় খাবার খেলে মানুষ যেসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে তার মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ, আলসার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদি। এসব রোগের মধ্যে হেপাটাইটিস অত্যন্ত ভয়ংকর হতে পারে। হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ অসতর্কতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব। লিভারের প্রদাহকে হেপাটাইটিস বলা হয়। হেপাটাইটিস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। হেপাটাইটিসের মূল কারণ হেপাটাইটিস ভাইরাস। তবে অন্য কোনো সংক্রামক রোগ, অ্যালকোহল, দূষিত খাবার, কিছু বিশেষ ওষুধ ও বিষাক্ত দ্রব্য হেপাটাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। হেপাটাইটিস ভাইরাস পাঁচ রকম এবং এসব ভাইরাসের নামের ওপর ভিত্তি করেই হেপাটাইটিসের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। দু-একটি হেপাটাইটিস ভাইরাস অত্যন্ত ভয়ংকর হতে পারে এবং এগুলো লিভারের ক্ষত সৃষ্টি করা ছাড়াও সিরোসিস বা ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।

বিশেষ করে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস সংক্রমণের কারণে লাখো মানুষ লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায়। হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ সাধারণত দূষিত খাবার খাওয়া এবং পানীয় পান করার কারণে সৃষ্টি হয়। শরীরের দূষিত রক্ত বা তরল পদার্থের সংস্পর্শে এলে সৃষ্টি হয় হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’ ও ‘ডি’। এসব রোগ ছড়ায় সাধারণত দূষিত রক্ত বা রক্তজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ বা প্রদানের মাধ্যমে। বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত দূষিত মেডিক্যাল যন্ত্রপাতিও ভয়ংকর হেপাটাইটিসের কারণ হতে পারে। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগী কর্তৃক ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, সুই, শেভিং রেজর বা অন্যান্য জিনিস ব্যবহার করা ঠিক নয়, যা মানবদেহের রক্ত বা শরীরের তরল পদার্থের সংস্পর্শে আসতে পারে।

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে প্রয়োজন সবার সচেতনতা ও সদিচ্ছা। এ ছাড়া ভোক্তার কাছে মানসম্পন্ন মাছ, মাংস ও দুধ পৌঁছানো নিশ্চিতে পর্যাপ্তসংখ্যক ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণে নজরদারি বাড়ানো এবং কর্মক্ষম জাতি গঠনে সব মানুষের জন্য নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। মেধা-মননে উৎকর্ষ ও কর্মক্ষম একটি জাতি গঠনে সব মানুষের জন্য নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে সবাইকে সততার সঙ্গে কাজ পরিচালনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি সুস্থ জাতি দিতে পারে একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ। জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। শুধু রেস্তোরাঁর খাবারের মাধ্যমেই নয়, গবেষণায় দেখা গেছে মাছের শরীরে, এমনকি নামিদামি ব্র্যান্ডের লবণেও প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিক গ্রহণ করছে।

তাই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্লাস্টিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেশীয় প্রজাতির ১৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের (মাইক্রো প্লাস্টিক) সন্ধান পেয়েছেন। কালিবাউশ, রুই, কই, বেলে, টেংরা, বাটা, তেলাপিয়া, কমন কার্প, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিলং, বাইম, টাটকিনি ও বাছা প্রজাতির মাছসহ কৃত্রিম উপায়ে মিষ্টি পানির জলাধারে চাষ করা মাছে এই নমুনা ধরা পড়েছে। গবেষণায় জানা যায়- টেংরা, টাটকিনি, রয়না বা মেনি মাছে প্লাস্টিকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এসব মাছে পলিপ্রপিলিন পলিথিলিন কপোলিমার, হাই ডেনসিটি পলিথিলিন ও ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট প্লাস্টিক পলিমারের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। গবেষকরা জানান, এসব প্লাস্টিক কণা সরাসরি খাদ্যের সঙ্গে মানুষের দেহে প্রবেশ করে না। তবে এগুলো থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত রাসায়নিক মাছের দেহে জমা হয়। পরে এসব মাছ খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে মানুষের দেহে স্বাস্থ্যঝুঁঁকি তৈরি হয়। নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়; তেমনি অনিরাপদ খাবার গ্রহণের কারণে দেহে ক্যানসার, কিডনির রোগ ও বিকলাঙ্গতাসহ অনেক রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। নিরাপদ খাদ্যের জন্য প্রয়োজন খাদ্য উৎপাদনে নিরাপদ প্রযুক্তি ও নিরাপদ খাদ্য উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম আরো বেগবান করা জরুরি। অপরদিকে, গবেষকরা খাবার লবণেও পেয়েছেন মাইক্রো প্লাস্টিক। বঙ্গোপসাগরে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকদ্রব্য, নিত্যব্যবহার্য পণ্যে মাইক্রো এবং ন্যানো পর্যায়ের কিছু প্লাস্টিক থাকে, যা লবণে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের জন্য অধিক পরিমাণে দায়ী। মানব শরীরে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক দীর্ঘদিনব্যাপী থাকে। এতে অন্যান্য ক্ষতিকর অণুজীব তার ওপর বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব প্লাস্টিকের কণা থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা হরমোনের সমস্যা সৃষ্টি এবং স্তন ক্যানসারের ঝুঁঁকি বাড়িয়ে দেয়। কয়েকদিন আগে লবণের মধ্যে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। তার মানে আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক ফেলি সাগরে তা পানিতে মিশে ছোট ছোট কণা হয়ে যায়।

সেগুলো লবণের মাধ্যমে মানব শরীরে যাচ্ছে। এটাও একটি উদ্বেগের বিষয়। নিরাপদ খাদ্যের জন্য প্রতিটি ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে সচেতনতা। ব্যবসায়ীদেও ভেজাল মিশিয়ে লাভ করার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খাবার গরম থাকায় প্লাস্টিক থেকে এক ধরনের পদার্থ নির্গত হয়ে খাবারের সঙ্গে মিশে তা চলে যাচ্ছে শরীরে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে, বিশে^র মানুষ না জেনেই প্রতি সপ্তাহে খাবারের সঙ্গে ৫ গ্রাম মাইক্রো প্লাস্টিক গ্রহণ করে। সারা বছরের হিসাব করলে এই পরিমাণ একটি প্লাস্টিক পাত্রের সমান দাঁড়ায়। রাস্তার ধারে কিংবা অলি-গলিতে অবস্থিত রেস্তোরাঁর খাবার পার্সেলে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। আবার খাবারের প্যাকেটে ব্যবহার করা হচ্ছে স্ট্যাপলারের পিন। দুটিই জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

খাদ্যের উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খাদ্যের নিরাপত্তা ও পুষ্টিমান বজায় রাখা জরুরি। দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যিনি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তার যেমন সচেতনতা প্রয়োজন; তেমনি যিনি ভোগ করবেন, তার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে। ভেজাল ও দূষণমুক্ত নিরাপদ খাদ্যেও প্রাপ্তির জন্য সরকার নির্দেশিত নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি, ভেজাল ও দূষণবিরোধী অভিযান পরিচালনা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যক্রম ও দেশি-বিদেশি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। খাদ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি স্থাপন করেছে। ল্যাবরেটরিতে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম পরীক্ষা করে এর গুণগত মান ও পুষ্টিমান নিশ্চিত করা জরুরি। জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অংশীজনদের প্রায়োগিক ভূমিকার মাধ্যমে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

Beta version