করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব আমাদের রাজস্ব খাতেও পড়েছে। এতে কর-রাজস্ব আহরণ কমে গেছে। গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আহরণ হয় মাত্র ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে করা হয় ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। এটিও অর্জন হয়নি। চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অতিমারীর অব্যাহত নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সেটি কতটুকু পূরণ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ব্যক্ত করছেন অর্থনীতিবিদরা। এর অন্যতম প্রধান কারণ বিদ্যমান কর ব্যবস্থা খুব একটা করদাতাবান্ধব নয়। কাজেই করদাতাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতে রাজস্ব ব্যবস্থা আরো সহজ ও ঝামেলাহীন করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকার তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যকর উদ্যোগ কাম্য।
১৯৯০ সাল থেকে বিগত দুই দশকে নিম্নআয়ের দেশগুলোতে আয়কর ও মূল্য সংযোজন করের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির ফলে রাজস্ব আয় মোট জিডিপির ১৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ মধ্যআয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধারা পরিলক্ষিত হয়। তারপরও দারিদ্র্যপীড়িত ও অভাবগ্রস্ত দেশগুলোতে উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দেশীয় রাজস্ব আয়ে ঘাটতি রয়েই গেছে। জিডিপির অনুপাতে সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায়কারী বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যেসব দেশে এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাস যেমন- বাংলাদেশ, ভারত ও নাইজেরিয়াÑ এসব দেশে জিডিপির অনুপাতে কর-রাজস্বের হার এখনো ১৫ শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশে জাতীয় রাজস্বের একটি বড় খাত হলো কর-রাজস্ব। এ খাত থেকে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ মোট রাজস্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ। সমপর্যায়ের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত আনুমানিক ১০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত যা সবচেয়ে কম। এর পেছনে দায়ী মূলত সংকুচিত করভিত্তি, বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা। বাংলাদেশের স্বল্প কর আহরণ সূচকের (লো ট্যাক্স-ইফোর্ট ইনডেক্স) মান ০.৪৯৩, যা থেকে বোঝা যায়, দেশের রাজস্ব আদায় সক্ষমতা এখনো অদক্ষতার পর্যায়েই রয়ে গেছে। বর্তমান রাজস্ব আহরণ সক্ষমতার উন্নয়ন করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি পুনর্গঠনসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আরো আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। বর্তমানে মাত্র ২১ শতাংশ বা ৩৩ লাখ মানুষ আয়কর দেন। আয়কর দাতার সংখ্যা বাড়ানো এবং রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য যেসব নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে তাদের সবাইকে আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ দিতে বাধ্য করা উচিত। কর্পোরেশনের জন্য টিআইএন প্রথা চালু রাখলে করদাতার সংখ্যা বাড়বে এবং রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
উল্লেখ্য, আমাদের রাজস্ব প্রাপ্তির প্রধান উৎস হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর। প্রত্যক্ষ কর হলো দেশের নাগরিকদের আয় ও সম্পদের ওপর নির্দিষ্ট হারে আদায়কৃত সরকারি রাজস্ব। এর বিপরীতে রয়েছে পরোক্ষ কর বা মূল্য সংযোজন কর যা পণ্য ও সেবা উৎপাদন এবং বিক্রয়, আমদানি, রপ্তানি আর অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় বাণিজ্যের ওপর আরোপ করা হয়। প্রত্যক্ষ কর সাধারণত দুই প্রকার। এক. আয়কর দুই. সম্পদ কর। বছরের আয়ের ভিত্তিতে আদায়যোগ্য করের নাম আয়কর। অপরদিকে অর্থবছরের শেষ অর্জিত সম্পদের ওপর আরোপিত করের নাম হলো সম্পদ কর। সব করের দায়ভার দেশের নাগরিকদেরই বহন করতে হয়। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে নাগরিক তার ওপর ধার্যকৃত কর সরাসরি সরকারের কোষাগারে জমা দেন। অন্যদিকে পক্ষে কর পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয়ের সময় মূল্যের সাথে সংযোজিত থাকে যেটা ক্রেতা, অর্থাৎ জনগণই পরিশোধ করেন। আদায়কৃত কর ব্যবসায়ী কর্তৃক সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়।
এবার আসা যাক পরোক্ষ করের কথায়। আর্থিক চার্জ যা ব্যয়ের চূড়ান্ত ধারক থেকে কোনো মধ্যস্বত্বকারি দ্বারা সংগ্রহ করা হয়। মধ্যস্বত্বভোগী পরে একটি ট্রাক্স রিটার্ন ফাইল করেন এবং আদায়কারি কর্তৃপক্ষ বা সরকারকে সংগৃহীত পরিমাণ জমা দেন। অপ্রত্যক্ষ ট্যাক্স বা করের উদাহরণগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে মূল্য সংযোজন কর, কেন্দ্রীয় কর, শুল্ক, পরিষেবা কর এবং সিকিউরিটিজ লেনদেন ট্যাক্সের মধ্যে রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্য হলো প্রত্যক্ষ কর প্রগতিশীল এবং পরোক্ষ কর অপ্রগতিশীল। এর অর্থ হলো করের জন্য যে পরিমাণ পাওয়া যায় তার সাথে প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি পায় এবং পরোক্ষ ট্যাক্স করের জন্য উপলব্ধ পরিমাণে হ্রাস করে। প্রত্যক্ষ কর প্রদান থেকে দূরে থাকতে পারে অন্যদিকে পরোক্ষ ট্যাক্স প্রদান করা থেকে বিরত থাকা। প্রত্যক্ষ কর ফাঁকি দেয়া সম্ভব। অন্যদিকে পরোক্ষ করে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া খুবই সম্ভব কারণ এটি পণ্য ও পরিষেবার দামের অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যক্ষ কর মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে পরোক্ষ কর মুদ্রাস্ফীতি প্রচার বা প্রসার করে। প্রত্যক্ষ কর একই ব্যক্তির ওপর পড়ে। অন্যদিকে পরোক্ষ কর বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর পড়ে। প্রত্যক্ষ কর স্থানান্তরিত হতে পারে না। অন্যদিকে পরোক্ষ ট্রাক্সগুলো একজন ব্যক্তির হয়ে অন্য ব্যক্তিতে স্থানান্তরিত হতে পারে। সংগ্রহ করা সহজ এবং কম প্রযুক্তিগত সত্ত্বেও অপ্রত্যক্ষ ট্রাক্সগুলো বিস্তৃত কভারেজ এবং বিপুলসংখ্যক লোককে আচ্ছাদন করে কারণ তারা মূল্য সংযোজন ট্যাক্স বন্ধনীতে হাইলাইট করা পণ্য এবং পরিষেবাদি ক্রয়কারি যে কোনো ব্যক্তির ওপর কর আদায় করা হয়। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ ট্যাক্স নিযুক্ত ব্যক্তিদের একটি সামান্য অনুপাতকে কভার করে কারণ এটি আয়ের ওপর চার্জ হয়।
সরকারি আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে কর রাজস্ব বাবদ সংগৃহীত অর্থ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর থেকে বাংলাদেশ সরকারের মোট আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি সংগৃহিত হয় বা হচ্ছে। বাকি রাজস্ব সংগৃহিত হয় করবহির্ভূত বিভিন্ন খাত থেকে। একটা কথা আমাদের জানা দরকার যে, দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী সেদেশে রাজস্ব হারও তত বেশি। রাজস্ব সংগ্রহের হার একটি দেশের উন্নয়নের স্তর বা অবস্থান নির্ধারণের অন্যতম স্বীকৃত নির্ণয়ক। রাজস্ব আয়ের ওপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন। এ অবস্থায় রাজস্ব খাতে বা আদায় ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়, তাহলে স্বাভাবিক কারণেই উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে। কাজেই রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার একান্ত প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য গৃহিত সুনির্দিষ্ট জাতীয় কৌশলের পটভূমিতে জাতীয় বাজেট প্রণীত হয়। কিন্তু সম্পদের সীমাবন্ধতার কারণে বাজেটের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান হলে বাজেটের ঘাটতি দেখা দেয়। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে সেখানে সরকারকে বর্ধিত হারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সম্পদ ও আয় হস্তান্তরে অধিকতর ব্যবস্থা নিতে হয় বা হচ্ছে। এতে করে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও তা অর্থনীতিতে একদিকে এক বিরাট জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম ক্রয়ক্ষমতা তৈরির মাধ্যমের সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও তা অর্থনীতিতে এটি বিশাল অক্ষম জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম জীবনধারণে সহায়তা করে।
আমাদের দেশের রাজস্ব খাত এখনো দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ফলে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব, দুর্বল অবকাঠামো, আইনি সক্ষমতার অভাব ইত্যাদি। অপরদিকে সক্ষম করদাতাদের কর প্রদান না করার মনমাসনিকতা আরেকটি বড় সমস্যা। রাজস্ব ফাঁকির দিক দিয়ে হয়তো বর্তমান বিশে^ আমাদের বাংলাদেশই এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ নেপাল বা ভুটানেও এমন কর ফাঁকির প্রবণতা নেই। এসব ছোট দেশের রাজস্ব জিডিপিতে বাংলাদেশের চেয়েও এগিয়ে আছে। কর বা রাজস্ব দেয়া নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। আর আমাদের দেশ হলো নৈতিক অবক্ষয়ের দেশ। টাকা হলেই বাড়ি গাড়ি আর বিদেশে পাচার করেন অনেকে। কিন্তু সরকারকে কর দিতে রাজি নন। অথচ বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর নাগরিকরা কর দেয়াকে গৌরবের বিষয় বলে মনে করেন। আমি মনে করি, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হলে এনবিআরকে ঢেলে সাজাতে হবে, বাড়াতে হবে সক্ষমতা, থাকতে হবে আইনি ক্ষমতা যাতে ফাঁকিবাজ ও সক্ষম করদাতাদের করের আওতায় আনা যায়, বাড়াতে হবে জনবল ও অবকাঠামো। শক্তিশালী রাজস্ব খাতই রাজস্ব বাড়াতে পারে বলে আমি একজন সাবেক কর কমিশনার হিসেবে মনে করি। আমাদের মনে রাখা দরকার, দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। আমরা এখনো কাক্সিক্ষত উন্নয়নে পৌঁছাতে পরিনি। অপরদিকে চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে গতিশীল করার জন্য রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ছাড়া বিকল্প নেই। শক্তিশালী রাজস্ব খাতই উন্নয়নের পূর্বশর্ত, এটা মনে রাখতে হবে।
এসডিজির লক্ষ্য অর্জনেও আমাদের রাজস্ব খাতের উন্নয়ন জরুরি। সরকারের গৃহিত বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এখনো রয়ে গেছে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো কর-জালের (ট্যাক্স নেট) বাইরে রয়ে গেছে যা মোটেও কাম্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ে করদাতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও কর-জালের বাইরে রয়ে গেছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় করদাতার সংখ্যার দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রয়োজনীয় লোকবল এবং কারিগরি সক্ষমতার ঘাটতির কারণে ভ্যাট সংগ্রহ কার্যক্রম শক্তিশালী করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই বিষয়টি আমলে নিতে হবে এবং এর দ্রুত সমাধান করতে হবে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোঃ লিঃ।
মন্তব্য