-->

পহেলা ফাল্গুন ও মা-সন্তানের ভালোবাসা

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
পহেলা ফাল্গুন ও মা-সন্তানের ভালোবাসা

করোনার মধ্যেও গতকাল মহাসমারোহে সারাদেশে পালিত হলো পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব। এদিন হলুদ পোশাক পরে অনেকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন মনের আনন্দে। এ দিনটি আবার আন্তর্জাতিকভাবে ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ^ ভালোবাসা দিবস হিসেবেও পরিচিত। সব মিলিয়ে এই দিনটিতে প্রেমিক-প্রেমিকা ও তরুণ-তরুণীদের ছিল মিলনমেলা। তাদের মুখরতা ও প্রাণবন্ত উচ্ছ্বলতায় জেগে ওঠে এক নতুন বাংলাদেশ। দৈনিক ভোরের আকাশ প্রকাশ করে পহেলা ফাল্গুন সংখ্যা। অর্থাৎ গতকালের দিবসটির তাৎপর্য আমাদের দেশে বেড়েই চলেছে। এর ভালোমন্দ দুটি দিকই আছে। তবে আমরা আশাবাদী মানুষ। এই বিষয়টিকেও আমরা ইতিবাচক অর্থেই দেখতে চাই। বিশেষ করে ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্গুনের সংস্কৃতির মধ্যে আমরা সমন্বয় সাধন করে ফেলেছি। পহেলা ফাল্গুন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি পালনের পাশাপাশি আমরা বৈশ্বিক গুণাবলিকেও ধারণ করছি।

তবে এখানে একটি কথা না বললেই নয়। ভালোবাসা শব্দটির অর্থ ও পরিধি ব্যাপক। একে যেন আমরা খণ্ডিতভাবে না দেখি কখনো। পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, সমাজ-সংসার, রাষ্ট্র সব নিয়েই আমাদের চলতে হয়। এখানে পারস্পরিক সম্পর্কের যে বোঝাপড়া থাকে, সেখানে আমাদের আরো অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে হবে। বিশেষ করে আমরা লক্ষ করছি, ব্যস্ততার কারণে আমরা পরিবারে মা-বাবার প্রতি সময় দিতে পারছি না। তাদের প্রতি যত্নশীল হতে পারছি না। ফলে ভালোবাসা দিবসের অঙ্গীকার ও ব্যাপক তাৎপর্য থেকে আমরা সরে আসছি। পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি অনাদর ও বঞ্চনার বিষয়টি আজকাল সবার মনে ভীষণ দাগ কাটে। মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাথে আয় ও ব্যস্ততা উভয়ই বেড়েছে। এর সঙ্গে বেড়েছে পরিবারের অতি ছোট ও বয়স্কদের কষ্ট এবং যাতনার মাত্রা। বেড়েছে সীমাহীন অবহেলা ও দূরত্ব।

পরিবারের খুকিরা বড় হয়ে বাপের বাড়িতে আর থাকতে পারে না। চলে যায় স্বামীর পরিবারে। তারা ফেলে যায় বাবা-মায়ের সাথে মিলেমিশে থাকা আদরের দিনগুলোর সাথে আরো অনেক কিছু। মাঝে মাঝে খোঁজ-খবর নেয়া বা কিছু উপঢৌকন পাঠানো ছাড়া তাদের ভূমিকা বেশি কিছু থাকে না। তাই বৃদ্ধ বয়সে নির্ভরশীল বাবা-মা থেকে খুকিরা একরকম দূরেই চলে যায়। যদিও খুকিরা শিশুকালে তার ভাইদের মতো বাবা-মায়ের সাথে থেকে বড় হয়, আধুনিক জীবনের নানা চড়াই উৎরাই তাদেরকেও সহ্য করতে হয়- যদি বাবা-মা কর্মজীবী হন, তবে খুকির চেয়ে খোকার ওপর সিংহভাগ নির্ভরশীল বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কথাই আলোচনায় ফিরে ফিরে আসে বার বার।

এর কারণ, খোকা বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করার সাথে সাথে ভিন্ন পরিবারের আরেকজনকে নিয়ে নিজের জীবন সাজাতে শুরু করে। সেই ভিন্ন পরিবারের মেয়েটির সঙ্গে অনেক বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মনের মিল হয় না। অধিকাংশ সময় সেখান থেকে বিপত্তি শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে খোকার বিয়ের পর সংসারের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়। এরপর সংসারে সন্তানের সংখ্যা বেশি থাকলে এবং তারা একেকজন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় জীবন-জীবিকার তাগিদে বসবাস শুরু করলে বৃদ্ধ বাবা-মা কোন্ সন্তানের সঙ্গে বসবাস করবেন, কী খাবেন, কে নিয়মিত ওষুধ খাওয়াবেন তা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। এছাড়া এক বাবা-মায়ের সব বাচ্চা বা সব খোকার আর্থিক অবস্থা সমান হয় না বিধায় তা নিয়ে পছন্দের সমস্যা তৈরি হতে দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে সন্তানদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। এগুলো হরদম ঘটছে। এই বিরোধ মানসিক সমস্যা ও অভিমান তৈরি করলে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। তাঁদেরকে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠানোর প্রশ্ন এখান থেকে বেশি শোনা যায়।

গ্রামের কোনো পরিবারে কেউ উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরি লাভ করলেই গ্রামছাড়া হতে শুরু করে। বদলির চাকরি হলে তো কোনো কথাই নেই। এক সময় বাবা-মা গ্রামবাসী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। বিয়ের পর শুধু স্ত্রী-সস্তান নিয়ে শহরবাসী হয়ে পড়েন। সেই পরিবারে যদি স্বামী-স্ত্রী দু’জনই কর্মজীবী হন তাহলে তারা প্রাথমিকভাবে বাবা-মাকেও সাথে নিয়ে শহরে চলে যান। যাদের বাবা-মা নেই তারা শ^শুর-শাশুড়ির দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। তার প্রধান কারণ, নিজেদের ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই কাজে চলে গেলে নিজের বাচ্চাকে তো আর কাজের বুয়ার তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়া যায় না। তবুও আজকাল সবার বাবা-মা বা নিকটাত্মীয়রা এই ধরনের সেবা দিতে পারেন না। তাই কাজের বুয়ার সাহায্য নিতে হয়। তবে বর্তমানে বিশ^স্ত কাজের বুয়ার সংকট থাকায় দুজন চাকরি করা পরিবারে সন্তান প্রতিপালনে বেগ পেতে হচ্ছে।

আমাদের দেশে ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোতে উন্নত দেশের মতো সেবার ব্যবস্থা না থাকায় এই সংকট সামনে আরো বেশি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে থাকবে। হয়তো জাপানের মতো দুজন চাকুরে সম্বলিত পরিবারে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাবে। তখন ওদের দেশের মতো আমাদের দেশের জনসংখ্যার হার নিম্নগতি হতে হতে শূণ্যের কোটায় নেমে যেতে পারে। অনেক আধুনিক পরিবারে কাজের বুয়ার কাছে বাচ্চাদের রেখে অফিসে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তারা বিকল্প হিসেবে বাসায় আধুনিক সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে অফিস থেকে বার বার ক্যামেরার মাধ্যমে শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। তবে সম্প্রতি এই সিসি ক্যামেরাতে ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে।

দেখা গেছে, শিশুর প্রতি যত্ন না নিয়ে কাজের বুয়া শিশুর খাবার নিজে খেয়ে ফেলেছে। সে সারাক্ষণ টিভির রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল পরিবর্তন করে সিনেমার নাচ-গান দেখতে ব্যস্ত। শিশু খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাকে মারধর করা হচ্ছে। শিশুর কান্না না থামলে তার টিভি দেখার ব্যাঘাত ঘটে। তাই সে শিশুর কান্না থামাতে অনবরত চড়-থাপ্পড়, এমনকি বারবার লাথি মেরে চরমভাবে নিযার্তন করছে। এমন একটি ঘটনার দৃশ্য আমাদের দেশে এক চাকুরে দম্পতির শিশুর কপালে জুটেছিল। বাধ্য হয়ে তারা দ্রুত বাসায় এসে শিশুকে হিংস্র বুয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিল।

এভাবে দিন যতই গড়াচ্ছে আধুনিক শিক্ষিত কর্মজীবীদের পরিবারের শিশুরা বাবা-মায়ের আদর-যত্ন ও ভালোবাসা ব্যতিরেকে বড় হচ্ছে এবং নানাভাবে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা বঞ্চিত এসব শিশু বড় হয়ে নিষ্ঠুর আচরণ করছে অন্যদের সাথে। তারা সহপাঠী ও বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে চলতে পারে না। ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতে পছন্দ করে। কোনোকিছু শেয়ার করার মানসিকতা হারানো এসব শিশু সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। তারা একদিন কিশোর গ্যাং, মাস্তানি ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে বড় বড় অপরাধ করতে উদ্যত হচ্ছে। এসব ভালোবাসাবঞ্চিত শিশুদের শাসন করা খুব বিপজ্জনক। তারা একটু কড়া কথা সহ্য করতে পারে না। সামান্য ব্যাপারে ক্ষেপে যায়, বিগড়ে যায়। পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়ায় তাদেরকে শিক্ষক কিছু বললেই স্কুল পালানোর প্রবণতা তৈরি হয় তাদের মধ্যে। যেটা তাদের বাবা-মায়েরা জানতেই পারে না। স্কুলে যাওয়ার নামে ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা দেয়। এভাবে একদিন বাবা-মায়ের টাকা-পয়সা চুরি করে সিনেমা, সাইবার ক্যাফে, রেস্টুরেন্টে ঢুকতে থাকে। খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হয়ে যায় মাদকাসক্ত। অনেক গবেষণায় এসব ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিক্ষিত কর্মজীবী মায়েদের পরিবারে বাবারাও কর্মজীবী হলে এবং নিকটাত্মীয়রা কোনোরূপ সেবা সহায়তা দিতে অপারগ হলে এই সমস্যা সেসব শিশুদের জীবনে নিয়ে আসে চরম হতাশা ও বঞ্চনা।

এসব শিশু বড় হয়ে তাদের বাবা-মায়ের প্রতি তেমন ভালো আচরণ করতে চায় না। বিশেষ করে বিয়ের পর তাদের সংসার বড় হয়ে গেলে সেখানে তাদের বাবা-মায়ের অবস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। দু’একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া শিশুকালে বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা বঞ্চিত খোকনরা বড় হয়ে তাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে কাছে রাখে না। বাবা-মায়েরাও তাদের কাছ থেকে আদর-যত্ন, সম্মান না পেয়ে নিজেদেরকে বোঝা মনে করে। তাদের নিজেদের জীবনের প্রতি ধিক্কার ও ঘৃণা জন্মে। তাই তারা অভিমান করে আর বেশিদিন এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে চান না। অন্যের কাছে সেসব দুঃখের কথা প্রকাশ করেন। আপন পেটের সন্তানের মায়া ছিন্ন করে তারা বৃদ্ধ নিবাসে থাকতেই পছন্দ করেন।

এভাবে বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যেকার ভালোবাসা, মায়া-মমতার কাহিনি একদিন শুধু গল্পে পরিণত হয়ে যায়। উন্নত বিশ্ব বয়স্ক ও নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকারিভাবে বয়স্কদের জন্য ভাতা ও আবাসনের ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে এখনো সেই সুবিধা গড়ে উঠেনি। শুধু কিছু গ্রামীণ দুস্থ বয়স্কদের জন্য সামান্য পরিমাণে বয়স্কভাতার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। শহুরে দুস্থ বয়স্কগণ অনেক বিত্তশালী পরিবারের সদস্য হয়েও পরিবারের নিজের সন্তানের মাঝে বসবাস করতে পারেন না। তাদেরকে জোর করে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠিয়ে দেয়ার কথা শোনা যায়। যেটা চরম অমানবিক। খোকার স্ত্রী, সন্তানদের কাছে অনাদর আর অবহেলায় তারা জীবন সায়াহ্নে বৃদ্ধ নিবাসে চোখের জল ফেলে একদিন মরণকে বরণ করে নেন। সেটাও একদিন একটি অমানবিক গল্প হয়ে ভেসে ভেসে আকাশ বাতাস ভারী করে ফেলে।

আজ যারা যুবক আগামীকালই তারা বৃদ্ধ হয়ে যাবেÑ এটা ভুলে যায় অনেকেই। নিজেদের জীবনের শেষ বেলার কথা কেউ স্মরণে আনতে চায় না। কোনো খোকা তার মাকে বঞ্চিত করলে সেও একদিন তার নিজের খোকা দ্বারা অবহেলিত ও বঞ্চিত হবে এই কথা স্মরণ করে প্রতিটি মানুষকে প্রকৃত শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মানবতাবাদী হওয়ার জন্য তৎপর হতে হবে। এজন্য নতুন বছরে ও ফাল্গুন মাসে জরুরিভিত্তিতে সবাইকে নতুন করে এ বিষয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্বিবিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

মন্তব্য

Beta version