-->

হাওর অঞ্চলের পর্যটন ও উন্নয়ন

এস ডি সুব্রত
এস ডি সুব্রত
হাওর অঞ্চলের পর্যটন ও উন্নয়ন

হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল জলরাশি। বর্ষায় দুচোখ যেদিকে যায় শুধু পানি আর পানি। বিধাতার কি অপরূপ লীলা! শুকনো মৌসুমে পানির পরিবর্তে মাঠজুড়ে ফসলের সমারোহ দুচোখ ভরিয়ে দেয়।

শুকনো মৌসুমে কাঁচা সোনা ধানেহাওর স্বপ্নের বুনন চলেভরা বর্ষার সীমাহীন অথৈ জলেযৌবনবতী হাওরে প্রাণ আসে।

হাওর নিয়ে এভাবে কত কবি যে মুগ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই অঞ্চল বরাবরই অবহেলিত ও উপেক্ষিত। ইদানীং হাওর অঞ্চলে কিছুটা উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে। সেখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু হাওর অঞ্চলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। উইকিপিডিয়ার মতে, ‘হাওর হলো সাগরসদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর’। সায়র বা সাগর শব্দ থেকে হাওর শব্দের উৎপত্তি। হাওর হলো বিস্তৃত প্রান্তর, অনেকটা গামলা আকৃতির জলাভূমি, যা ভূ আলোড়নের ফলে সৃষ্টি হয়। হাওর অঞ্চলে ছয় মাস শস্যক্ষেত্র থাকে পানির নিচে আর গ্রামগুলো পানিতে ভেসে থাকে দ্বীপের মতো। এটা বর্ষাকালের চিত্র। ছয় মাস থাকে শুকনো গ্রীষ্ম মৌসুমে। এ সময় যতদূর চোখ যায় মাঠের পর মাঠ, সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায়। বর্ষায় হাওরের বুকজুড়ে চলে অপরূপ জলের নাচন। হিজল করচে শাপলা শালুকে হাওর সাজে অপরূপ সাজে। বর্ষার ভরা জলে হাওরে যেন যৌবনের ডাক আসে। শুকনায় উদাত্ত জলের দেশে সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায় অপরূপ সবুজে। বৈশাখে সোনালি ধানে স্বপ্নের চাঁদ জাগে হাওরে। হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে থৈ থৈ বিশাল জলরাশি। সে জলে চলে কখনো ভাঙা-গড়ার খেলা, কখনো আফালের ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙে বসতি। কখনো বন্যায় ভেসে যায় গেরস্থালি। অকাল বন্যায় স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার ফসল ভালো হলে হাওরে আনন্দের জোয়ার আসে। বর্ষায় বিকেলে চলে নৌকাবাইচ। গ্রামে গ্রামে চলে গাজীর গান, যাত্রাপালা। হাওরের শিল্প-সংস্কৃতি আজ অনেককেই বিমুগ্ধ করছে। দিন যতই যাচ্ছে, হাওরের প্রতি মানুষের গভীর টান লক্ষ করা যাচ্ছে। পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখন ভ্রমণের জন্য হাওর অঞ্চলকে বেছে নিচ্ছেন। এখানে তাই পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু আমরা তা কতটা কাজে লাগাতে পারছি?

হাওর অঞ্চল বলতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াÑ এই ৭টি জেলার হাওর অঞ্চলকে বুঝায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সমুদ্রবক্ষ থেকে জেগে উঠেছে হাওর। হাওর অঞ্চল মোট ৩৭৩টা। এসব হাওরের মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৯৭টি, সিলেটে ১০৫টি, সুনামগঞ্জে ৯৫টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, হবিগঞ্জে ১৪টি, নেত্রকোনায় ৫২টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। ৩৭৩টি হাওরবেষ্টিত অঞ্চলে রয়েছে ৩ হাজারের অধিক জলমহাল, যেখান থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন মাছ। বর্ষাকালে হাওর অঞ্চল ১০-৩০ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আবার বর্ষা শেষে হাওর অঞ্চলে শুকনা মৌসুমে বিভিন্ন ফসলের সমারোহ দেখা যায়। মানুষের মন খুশিতে নেচে ওঠে এ সময়।

হাওরের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে দেশ হাওর রয়েছে ৪১৪টি। আবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী হাওরের সংখ্যা ৪২৩টি। সহযোগী একটি দৈনিক পত্রিকার তথ্যমতে, হাওরের সংখ্যা ৩৭৩টি। হাওর অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি, যার ৭০ ভাগ কৃষিজীবী।

বাঙালির হাজার বছরের যে ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি তার এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে হাওর অঞ্চলের মানুষের আনন্দ-বেদনার গল্প। বাউল জারি সারি, আধ্যাত্মিক আর ধামাইল গানের মূল উৎসস্থল হচ্ছে হাওর অঞ্চল। হাওরের রাজধানী আর লোকসংস্কৃতির অন্যতম আধার সুনামগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন মরমি সাধক দেওয়ান হাসন রাজা, বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম, ধামাইল গানের জনক রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ এবং পণ্ডিত রামকানাই দাশ প্রমুখ। বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বর্ণনায় বর্ষার ভাসান জলে হাওরের মানুষের মাছ ধরে খাওয়া আর মনের আনন্দে গান গাওয়ার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। নৌকাবাইচ আর যাত্রাপালার দেখা মেলে বর্ষার হাওরে। অন্যদিকে অকাল বন্যা অথবা হাওর রক্ষা বাঁধে অনিয়মের কারণে ফসল তলিয়ে গেলে হাওরের সহজ-সরল মানুষের জীবনে দুঃখ-দুর্দশার চিত্র দেখা যায় প্রায়শই। বাংলাদেশের প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় মিঠা পানির এ হাওর অঞ্চলে।

প্রায় ২৬ হাজার গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত হাওর অঞ্চলের বিষাদের গল্প ফুটে ওঠে এভাবেÑ

‘মাটির উপরে জলের বসতি, জলের উপর ঢেউতরঙ্গের সাথে পবনের পিরিতি নগরের জানে না কেউ’।হাওরের অপরূপ রূপবৈচিত্র্যের আড়ালে লুকানো বেদনার শাশ^ত রূপ ফুটে উঠেছে লোকগীতির চরণ দুটিতে।অপরদিকে হাওরের অনন্য রূপবৈচিত্র্যের দেখা মেলে কবিতার পঙক্তিতে...

‘পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে জলেপৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে আকাশ ছড়ায়েছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশেছুটছে প্রকৃতিপ্রেমী মহোৎসবের প্রশান্তি লাভে অসীমের পানে।’

হাওরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাংসহ দেশি-বিদেশি পর্যটক। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা হাওরের অপার সৌন্দর্য অবলোকন করে হাওরকে উড়াল পক্সক্ষীর দেশ বলেছেন। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হলেও হাওরে মূলত দুটো ঋতু প্রভাব ফেলে। একটা হচ্ছে বর্ষাকাল। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে বাইরা মাস বা বাইসসা কাল বা অদিন। আরেকটি হচ্ছে শুকনো মৌসুম বা সুদিন। শুকনো মৌসুমে বা সুদিনে হাওরজুড়ে সবুজের সমারোহ ধান আর ধান এক সময় সোনলি ধান, বৈশাখে ওঠে কৃষকের গোলায়। আনন্দে ভরে ওঠে হাওরের কৃষাণ-কৃষাণীর মন।

অন্যদিকে বর্ষায় বা অদিনে চারদিকে থৈ থৈ পানি। নৌকা হয়ে উঠে যাতায়াতের একমাত্র বাহন। যৌবনবতী হয়ে ওঠে হাওর। ফসল ভালো হলে হাওরে বিয়েশাদিও ধুম লাগে। গ্রামে গ্রামে চলে যাত্রাপালা আর মালজুড়া গান। গ্রামের বধূরা অবসর পেয়ে নৌকা করে নাইর যায় বাপের বাড়িতে মনের আনন্দে। আনন্দ-আহ্লাদের মাঝে দুঃখও আছে। আছে অকাল বন্যা বা পাহাড়ি ঢলে ফসল তলিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ আছে ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় তিক্ত অভিজ্ঞতা। আছে ওয়াটার লর্ডদের জুলুমে নিষ্পেষিত জেলেদের চাপা কান্না। হাওরের চাপা কান্না ভেদ করে এর শান্ত জলে অবগাহনে হাজারো পর্যটকের মনে প্রশান্তির ঢেউ জাগে। প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের অপরূপ নান্দনিক ছোঁয়ায় হাওর যেন এখন হয়ে ওঠে স্বপ্নের দেশে।

হাওর এখন বিশ ঐতিহ্যের অংশ এবং বৈচিত্র্যের এক অপার লীলাভূমি। পর্যটনের স্বর্গরাজ্য যেন হাওর। হাওরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অমূল্য সম্পদ। একদিন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে নিশ্চিতভাবে। শুধু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। এখানে পর্যটনশিল্পের বিকাশে বিভিন্ন মনোরম হোটেল, গেস্ট হাউস ইত্যাদি গড়ে তোলা প্রয়োজন। বর্ষাকালে যোগাযোগের যে সমস্যা তা দূর করতে ব্রিজ-কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ জরুরি।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

মন্তব্য

Beta version