-->

বাংলা গানের অমর কণ্ঠশিল্পী

 লিয়াকত হোসেন খোকন
লিয়াকত হোসেন খোকন
বাংলা গানের অমর কণ্ঠশিল্পী

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখেছিলেন, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব।’ আর এই গানে কণ্ঠ দিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিংবদন্তি হয়ে রইলেন। তিনি এ পর্যন্ত ১০ হাজার গান গেয়েছেন, সব গানই তাকে খ্যাতি দিয়েছে।

সেই কবে ১৯৫৪ সালে অনুপম ঘটকের সুরে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সন্ধ্যা গেয়েছেন- ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। এ গান শুনলে বৃদ্ধরাও যৌবনে চলে যেতে যান। তার নামটি যেন হৃদয়ে ঝংকার তোলে। নামটির এমন মহিমা যে উচ্চারিত হলেই শ্রোতাদের মনের আকাশে এক লহমায় গানের ইন্দ্রধনু ফুটে ওঠে। যে কোনো লগ্নই হয়ে ওঠে গান শোনার। তার নাম শুনতেই কানের ভেতর নাকি মনে কিংবা মাথার ভেতর ভাঙতে থাকে গানের ঢেউ। তার গাওয়া- ‘মায়াবতী মেঘে আনে তন্দ্রা’, ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’, ‘মধুমালতী ডাকে আয়’, ‘বকম বকম পায়রা’, ‘এ গানে প্রজাপতি’, ‘নতুন সূর্য আলো দাও’, ‘ওগো মোর গীতিময়’, ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে’, ‘মধুর বংশী’, ‘কুহু কুহু কোয়েল’, ‘নেব না সোনার চাঁপা’, ‘সজনি ও সজনি’, ‘আমি প্রিয়া তুমি প্রিয়’, ‘ও ঝরাপাতা এমনি তুমি’, ‘হাতে কোনো কাজ নেই’, ‘যেখানে স্বপ্ন সুরে রইবে ভরে’, ‘না হয় রহিতে কাছে’, ‘বাঁশি বুঝি আর নাম জানে না’, ‘বঁধুয়া এলো না’, ‘চিনেছি তোমায় অচেনার মাঝে’, ‘তোমারে হারানো তো নয়’, ‘চৈতী ফুলের কী বাঁধিস রাঙা রাখি’, ‘পিয়া পিয়া পিয়া যে ডাকে আমায়’ এমনি অসংখ্য গান সংগীতশ্রোতাদের মনে ছড়িয়ে দেয় স্মৃতির কুয়াশা।

বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে আছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ৯১ বছর বয়সে চলে গেলেন এই পৃথিবীর মায়া ভুলে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর। ১৯৪৪ সালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সংগীতজগতে আসেন। তার প্রথম রেকর্ডকৃত গান- ‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’ এবং ‘তোমার আকাশে ঝিলিমিলি করে’। মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৪২ সালে তিনি রেডিওতে গান গাওয়া শুরু করেন। গানটি ছিল ‘যদি বা ফুরালো গান’। সিনেমায় প্রথম গান করেন ১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে। সেই রাইচাঁদ বড়ালের যুগ থেকে এ যুগের সুমনের সুরে গানও করেছেন তিনি।

অতীতের সঙ্গে আজকের তুলনাও করতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত ছিল, ‘সেসব দিনে শিল্পীরা নিজেদের উজাড় করে দিতেন, আজও রয়ে গেছে সেসব গান। আজকের সবই তো রেডিমেড- গানের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না শিল্পীরা। দু-দিনেই লোকে ভুলে যাচ্ছে এসব গান। এসব দেখলে বড় কষ্ট হয়। অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়ের মতো মিউজিক ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করা মানে প্রতিদিনই খানিকটা শেখা। আজকের শিল্পীরা সে সুযোগই পান না। এ নিয়ে আজকের শিল্পীরা আমার কাছেই আফসোস করেন।’ একসময় মুম্বাইয়ের শিল্পীদের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছিলেন। এ বয়সে সেসব স্মৃতি এখনো সন্ধ্যার মনে নাড়া দিত। মুম্বাইতে শচীন দেব বর্মণই তাকে ডেকে নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অনিল বিশ্বাসের সুরে লতার সঙ্গে গান করেছিলেন। সেই সূত্রে লতার সঙ্গে তার খুব ভাব হয়। গীতা দত্তের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়েছিল।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় বাংলা গানের একটা পুরো অধ্যায়। বাংলা সিনেমার প্রথম ‘প্রিমা ডোনা’ কানন দেবীর হাত থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলেন এই সন্ধ্যা। পরবর্তী চার দশক (১৯৪৮ থেকে ১৯৮৮) সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা ছবির প্লেব্যাক-সম্রাজ্ঞীর আসনে। পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেত্রে ৬০ বছর ধরে সোনালি ফসল তুলে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন তিনি। তিনি যা অর্জন করেছেন তা মহিরুহের মতোই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানেই হেমন্ত-সন্ধ্যা, অনুপম-সন্ধ্যা, রবীন-সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র-সন্ধ্যা, মান্না-সন্ধ্যা, শ্যামল মিত্র-সন্ধ্যা, সুচিত্রা-সন্ধ্যাÑ এমন বহু উজ্জ্বল অধ্যায় ভরে রেখেছে তার শিল্পীজীবনে। এভাবেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় লিজেন্ড হয়ে রইলেন, যা সংগীতপ্রেমিকদের অহংকারী হওয়ার রসদ জোগায়।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলো আকাশের অস্তরাগে আমারই স্বপ্ন জাগে; আজ কেন ও চোখে লাজ কেন মিলনসাজ যেন বিফলে যায়; আমি তোমারে ভালোবেসেছি; আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি; আর ডেকো না সেই মধুনামে যাবার লগনে; উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা; এ গানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রং ছড়ায়; এ শুধু গানের দিন এ লগন গান শোনাবার; ওগো মোর গীতিময়; কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল; কে তুমি আমারে ডাকো অলখে লুকায়ে থাকো; চৈতি ফুলের কি বাঁধিস রাঙারাখি; গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু কার স্বপ্ন ছড়াতে চায়; গুন গুন মন ভ্রমরা কোথা যাস কীসেরই ত্বরা; ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত; জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া; ঠুন ঠুন ঠুন কাঁকনে যে কী সুর বাজে রে, বাজে রে, বাজে রে; তারা ঝিলমিল স্বপ্ন মিছিল; তুমি তো জানো না কত ব্যথা ভুলে থাকি; থই থই শাওন এল ওই; পথ ছাড়ো ওগো শ্যাম কথা রাখো মোর; পিয়া পিয়া পিয়া কে ডাকে আমারে; প্রজাপতি মন আমার পাখায় পাখায় রং ছড়ায়; মধুমালতী ডাকে আয় ফুল ফাগুনের এ খেলায়; মধুর মধুর বংশী বাজে; মরমী গো, আজি মনের কথাটি বলো না; মায়াবতী মেঘ এলো তন্দ্রা; যদি নাম ধরে তারে ডাকি; যারে যা যা ফিরে যা যা; হয়তো কিছুই নাহি পাব ইত্যাদি।

লেখক: চলচ্চিত্র ও ভ্রমণবিষয়ক গবেষক

মন্তব্য

Beta version