-->
শিরোনাম

শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক অধ্যাপক শামসুল হক মোল্লা

সৈয়দ ফারুক হোসেন
সৈয়দ ফারুক হোসেন
শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক 
অধ্যাপক শামসুল 
হক মোল্লা

না ফেরার দেশে চলে গেলেন শিক্ষার আলো ছড়ানো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শামসুল হক মোল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, সিনেট সদস্য, বাংলাদেশ গণিত সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রফেসর শামসুল হক মোল্লা গত মঙ্গলবার (১৫/০২/২০২২) সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে ঢাকার শ্যামলী সেন্ট্রাল হসপিটালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। সমগ্র জাতি তার বিদেহি আত্মার শান্তি ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। বুধবার ফজরের পর ধানমন্ডির নিজ বাসার নিকটস্থ মসজিদে, সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে, ঢাবির মসজিদ প্রাঙ্গণে ও বিকাল ৩টায় নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান কুমিল্লার মুবাদনগরে চাঁদ মিয়া মোল্লা ডিগ্রি কলেজ মাঠে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শুভানূধ্যায়ী রেখে গেছেন। আমরা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।

তিনি ছিলেন শিক্ষা উন্নয়ন ও মানবসেবায় নিরলস, নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন সৎ, বিনয়ী, স্পষ্টভাষি, পরোপকারী ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন খ্যাতিমান গণিতবিদ। বাংলাদেশ গণিত সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, ক্লিনিকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এই গুণী শিক্ষাবিদ। তিনি মানবসেবা ও শিক্ষাবিস্তারে অসামান্য অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়) গণিত বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই অবহেলিত গ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম চালিয়ে যান তিনি। নিজের গ্রামে প্রতিটি দরিদ্র মানুষের কাছে তিনি ছিলেন আশার আলো। ঢাকা থেকে কুমিল্লা লোকাল বাসে কষ্ট করে সপ্তাহান্তে গিয়ে বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-চাঁদ মিয়া মোল্লা ডিগ্রি কলেজ, তায়মোস বেগম উচ্চ বিদ্যালয়, আফরোজা হক কিন্ডারগার্টেন, তায়মোস-অফুলা ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, হক কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি মুরাদনগর, হোমনা, তিতাস উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রামে সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন।

অধ্যাপক শামসুল হক লিবিয়ায় একটি ইউনিভার্সিটিতেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। দেশে ফিরেই জীবনের কঠোর পরিশ্রমের সামান্য আয়ে চারদিকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে প্রথমেই ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন চাঁদ মিয়া মোল্লা ডিগ্রি কলেজ। পরবর্তীতে শিক্ষার মান উন্নয়নে গ্রামের অবহেলিত গরিব জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে গড়ে তোলেন প্রফেসর শামসুল হক মোল্লা ট্রাস্ট। ট্রাস্টের মাধ্যমে গড়েছেন অসংখ্য ক্লিনিক, গণ গ্রন্থাগার, ছাত্রাবাস, ঈদগাহ, মসজিদসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

গ্রামের অসহায় মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য হাতে নিয়েছেন আদর্শ গ্রাম প্রকল্প। তাকে সমাজে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আন্তজার্তিক ‘ডিস্টিংগুইশড লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর টোটাল সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট কর্তৃক ‘সেরা-সেবক’ পুরস্কার, ২০০৮ সালে বাংলাদেশ গণিত সমিতি কর্তৃক ‘বর্ষীয়ান গণিতবিদ সম্মাননা’, ২০১৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ গণিত বিভাগ কর্তৃক ‘আজীবন সম্মাননা’সহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে হলে সর্বপ্রথম নিজের অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হবে। অন্তরচেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। বর্তমান সমাজে আমরা হয়ে উঠেছি আত্মকেন্দ্রিক।

আমরা সর্বদাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আমরা নিজের বৈষয়িক চিন্তায় এতই মগ্ন যে, অন্যের সুখ-দুঃখ নিয়ে চিন্তা করার সময় আমাদের থাকে না। কিন্তু প্রফেসর শামসুল হক মোল্লা ছিলেন সবার থেকে একটু আলাদা। তিনি মানুষের উপকারের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। প্রকৃত মানুষ হতে হলে আমাদের চাই পরস্পরের প্রতি অন্তরের ভালোবাসা, চাই স্নেহ, মমতা ও স্বার্থপরতাহীনতা। যার পুরোটাই ছিল প্রফেসর শামসুল হক মোল্লার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবার কাছে সমভাবে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি।

ভদ্রতা, বিনয়ী, মানবতা বোধ, অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের ক্ষতির চেষ্টা বা ক্ষতির কামনা না করা এসব বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন তিনি। অসহায় মানুষের দুর্দিনে তাদের সর্বপ্রকার আর্থিক সহায়তা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, চিকিৎসাসেবা ও শুশ্রƒষায় এগিয়ে আসায় তিনি ছিলেন সবসময়ই অগ্রসর। তিনি সবার প্রতি দয়াশীল এবং ভদ্র স্বভাবের ছিলেন। তিনি নিজের আবেগ অনুভূতিকে সবার কাছে প্রকাশ না করে লুকিয়ে রাখতে বেশি পছন্দ করেন। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত ও মর্মাহত। তার মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক ডা. মো আখতারুজ্জামান, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুন।

লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য

Beta version