-->

বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম কমিটি

ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম বৈঠক হয়েছিল কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের একটি কক্ষে। আর সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাত্র কয়েকজন। যারা হলেন কাজী ইদ্রিস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শহীদুল্লাহ কায়সার, আতাউর রহমান, আখলাকুর রহমান প্রমুখ।

আলোচনার বিষয় ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের (আজকের বাংলাদেশের) যুবসমাজের করণীয় কি? এর কিছুদিন আগেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এক নিবন্ধে বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে ড. জিয়াউদ্দিন উত্থাপিত প্রস্তাবের বিপরীতে তিনি প্রস্তাব দিলেন, প্রস্তাবিত পাকিস্তানের যদি একটি ভাষায় হয় তবে গণতন্ত্র সম্মতভাবে শতকরা ৫৬ জনের ভাষা বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। আর একাধিক ভাষা হলে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে বলে তখনকার প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তার ধারক যুব সম্প্রদায়কে। এর ফলে সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের বৈঠকটি আয়োজন করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের অসাম্প্রদায়িক যুবসমাজের সম্মেলন ডাকতে হবে। বৈঠকের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় পৌঁছালেন, ঢাকার ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন আহ্বান করা হলো।

“একুশের রক্তাক্ত সংগ্রাম মুসলিম লীগ সরকারকে কোণঠাসা করে ফেলে। সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্ত বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত ও বিকশিত করার জন্য। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নির্দেশ দিলেন”

ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসানাতের বাড়িতে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেহেতু আশঙ্কা ছিল যে, এই সম্মেলনে খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার এবং তার অনুগ্রহপুষ্ট গুপ্তরা হামলা বা বাধার সৃষ্টি করতে পারে। ৭ সেপ্টেম্বর সম্মেলনে জন্ম নিল পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেন’ “পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে সে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চ‚ড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।” এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল। উচ্চারিত হয়েছিল নিজের মাতৃভাষায় বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকারের দাবি। জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করার দাবি।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে ভাষার যে দাবি উত্থাপিত হয়েছিল, তা সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ২৩ তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদে বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে তাকে প্রকাশ্যে ধিক্কার দিলেন লিয়াকত আলী খান। তিনি এবং রাজা গজনফর আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা ব্যক্ত করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি খাজা নাজিমুদ্দীন এবং তমিজউদ্দীন খান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেন। নাজিমুদ্দীন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিবেবে চায়।

ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১১ মার্চ ছাত্র ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা বসে। সভায় আগত কর্মীদের ষড়যন্ত্র শুরু হলো। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছিলেন আর সরকারের সঙ্গে আপস করতেও চাইলেন। আর তখনই একটি বজ্রকণ্ঠ গর্জে উঠল। উচ্চারিত হলো’ ‘সরকার কি আপসের প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দীন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে, তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে।’ এই বজ্রকণ্ঠ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে তখন সমর্থন দিয়েছিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, শওকত ও শামসুল হক সাহেব।

এ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে অলি আহাদ বলেছিলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছাতেন তা হলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।’ ১১ মার্চ হরতাল হয়েছিল, পিকেটিংও হয়েছিল। সেক্রেটারিয়েটের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আর অলি আহাদ, শামসুল হক, শওকতসহ আরো কয়েকজনকে। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে তখন গোট পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বেগতিক দেখে খাজা নাজিমুদ্দীন আপসের কথা তুললেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা চলার পর ৮ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো।

চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যেহেতু বঙ্গবন্ধুসহ ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা কারারুদ্ধ ছিলেন, তাই চুক্তির খসড়া কারাগারে নিয়ে গিয়ে তাতে তাদের সবার সম্মতি নেওয়া হয়। ১৫ মার্চ কারাগার থেকে নেতারা মুক্তি পেলেন। জেল থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু দেখলেন যে, পুলিশি জুলুম ও সরকারের গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তাদের দাবি আদায়ে বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধু তাদের কথা বুঝতে পারলেন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার সভা অনুষ্ঠিত হলো, যাতে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সভা শেষে সরকারকে দাবি মেনে নেওয়ার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতাকে নিয়ে শুরু হলো ব্যাপক আন্দোলন। পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর লাঠিচর্জ, কাঁদনে গ্যাস ছুড়ল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তখন আন্দোলন আরো গতিশীল হয়ে উঠল।

বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রæয়ারি ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্র-জনতা মিছিলসহকারে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে বেলতলায় মিছিল জমা হয়। সবাই অপেক্ষা করছিলেন পরবর্তী ঘোষণার জন্য। শামসুল হক চৌধুরী, গোলাম মওলা, আব্দুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে সংবাদ জানালেন যে, শেখ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি তার সমর্থন আছে।

আরো জানানো হলো যে, তিনি (বঙ্গবন্ধু) জানিয়েছেন, আইনসভা ঘেরাও করতে হবে, বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে আর মহিউদ্দিন সাহেব রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে। অনশনের নোটিশ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হলো ১৬ ফেব্রুয়ারি। যাওয়ার পথে নারায়গগঞ্জ স্টিমার ঘাটে তার সঙ্গে দেখা করলেন শামসুদ্দোহাসহ আরো কয়েকজন। তাদের বঙ্গবন্ধু জানালেন তার এবং মহিউদ্দিন সাহেবের অনশনের কথা। আরো বললেন যেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল-মিছিল শেষে আইনসভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর আদায়ের কথা। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সভা হলো। সেই সভায় জানানো হলো একুশের হরতালের প্রতি দৃঢ় সমর্থন।

একুশের রক্তাক্ত সংগ্রাম মুসলিম লীগ সরকারকে কোণঠাসা করে ফেলে। সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্ত বঙ্গবন্ধু তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলেন স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত ও বিকশিত করার জন্য। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নির্দেশ দিলেন। কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগ মুসলিম শব্দটি কেটে অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হলো।

১৯৫৫ সালে তার নেতৃত্বে জয়পুরহাটে আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সুপারিশ করা হয়। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তার মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন করেছিলেন ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করে। তার চিন্তাচেতনায় ছিল মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি বিধানের লক্ষ্যে। বাঙালিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই চেতনা ছিল সর্বদা সক্রিয়।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

মন্তব্য

Beta version