রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পর আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার মান ও মর্যাদা নিয়ে কথা বলছি, নির্ভুল বানানে বাংলা লেখার জন্য তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছি, আর হরহামেশায় ভুলে ভরা বাংলা লেখা নিয়ে খেদোক্তি করছি। আসলে বঙ্গবন্ধুসহ ভাষাসৈনিকদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে অভিপ্রায় ছিল, তার অনেক কিছুই আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। আমরা সবাই জানি, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল হলেও মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বস্তরে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা পাকিস্তান আমলে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। যদিও ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু কাগজে-কলমে বাংলাকে মর্যাদা দিলেও, বাঙালি সংস্কৃতি অবহেলিতই থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে। স্বাধিকার আদায়ে দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাঙালিরা লাভ করে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, জন্ম নেয় বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশে সবার আশা ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হবে। বিশেষ করে সরকারি দপ্তর, আদালত এসব স্থানে সাধারণ মানুষ বাংলায় কাজ চালাতে পারবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি আজও। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে বাংলা ভাষার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও বাংলাকে সর্বস্তরে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। পরবর্তী রাষ্ট্রপ্রধানগণ বাংলায় ভাষণ দেননি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলায় ভাষণ দেন এবং বাংলাকে জাতিংসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার প্রচলন থাকলেও শিক্ষার্থীরা বাংলা বানান ও বাক্য প্রয়োগে হরহামেশাই ভুল করছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইংরেজি অবশ্যই জানতে হবে। এজন্য বাংলা ভাষার পাশে ইংরেজি শিক্ষারও প্রসার ঘটানো দরকার। তবে সবার আগে প্রয়োজন সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রয়োগ ত্বরান্বিত হওয়া।
ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক বা ব্যকরণবিদগণ নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি করে ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। কিন্তু এখন অন্য ভাষার নাটক সিনেমা দেখে সাধারণ মানুষই মনের মতো করে শব্দ সৃষ্টি করছেন! ফলে নতুন প্রজন্ম এভাবেই ভুল শব্দ শিখছে। গণযোগাযোগ মাধ্যমেও প্রমিত বাংলার ব্যবহার অনেক কমে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলা নাটকে প্রমিত বাংলার জায়গায় আঞ্চলিক ভাষা প্রাধান্য পাচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ইংরেজিপ্রীতি বাড়ছে। বহু প্রতিষ্ঠানের বাংলা নামের পাশে সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ইংরেজি শব্দের বিশদ ব্যবহার আছে যত্রতত্র। যেমন, ডিএনসিসি, ডিএসসিসি, ইউনিয়ন পরিষদ ইউপি, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করর্পোরেশন-বিআইডব্লিউটিসি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন- ইউজিসি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর-ইউডিডি, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন-বিআরটিসি, ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কতৃর্পক্ষ-ডিটিসিএ, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ প্রভৃৃতি। এ ধরনের ব্যবহারের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ‘ওয়াসা’। ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়্যারেজ অথরিটি’র সংক্ষিপ্ত রূপ এটি। এ রকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। মনে রাখতে হবে, এভাবেই মানুষের মুখে মুখে বিদেশি শব্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হুমকির মুখে পড়বে বাংলা শব্দ, যা জাতিসত্তার মৌলিক উপাদানের ওপর হুমকি স্বরূপ। এর মধ্য দিয়ে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।
কয়েক বছর আগে বিচারপতির পদত্যাগপত্রে বাংলা বানান ভুল নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। আবার বাংলা একাডেমি কর্তৃক সঠিক বানানের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকলেও মানতে নারাজ অনেকেই। যেমন- ঢাকার প্রধান সড়কের পাশে ফার্মেসি ও ফটোস্ট্যাটের দোকানের প্রত্যেকটির সাইন বোর্ডে লেখা ‘ফার্মেসী’, ‘ফটোষ্ট্যাট’ ইত্যাদি। রাস্তা সংলগ্ন বেশকিছু রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ে যেগুলোতে লেখা ‘রেষ্টুরেন্ট’। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুণ্যস্থান ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ। কিন্তু, সেখানেও বানান ভুল দেখতে পাবেন। মেডিক্যালে ঢুকেই নজরে আসে ‘বার্ন এবং সার্জারি’ (বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট) বানান ভুল। একটু পেছন ফিরলেই চোখে মিলবে ইমারজেন্সি কমপ্লেক্সের ‘ইমারজেন্সি’ ভুল বানান। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের বানান ভুল করে ‘সুপ্রীম’ লেখা।
আবার একই শব্দ একেক সাইন বোর্ড বা দেয়ালে লেখা হচ্ছে একেক রকম। এতে একদিকে যেমন বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে, তেমনি শিশুর ভাষা বিকাশে ত্রুটি ঘটছে বলে ভাষা বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সাইন বোর্ড হচ্ছে চোখের ঝিলিক, প্রতিষ্ঠানের আয়না। প্রতিষ্ঠানের পরিচয় যদি ভুল বানানে থাকে তাহলে প্রথমেই একটা বিরূপ ধারণা চলে আসে। যেমন, ফার্নিচারের দোকানগুলোতে দেখা যায় ফার্নিচার শব্দটিই একেক দোকানে লেখা আছে একেক রকম। ‘মদিনা ফার্নিসারস’, ‘প্যারামাইন্ট ফার্নিশার্স’, ‘হোম ফার্নিশার্স’ বানানে লেখা হয়েছে শব্দটি। অটোমোবাইলসের সাইন বোর্ডে লেখা আছে ‘এহানে মুবিল, গিরিজ, পিট্রোল’ (এখানে মবিল, গ্রিজ, পেট্রোল) পাওয়া যায়। ‘রহমান অটোমোবাইলসের’ জায়গায় লেখা আছে ‘রয়মান অটোমোবাইল’, গ্রিজকে লেখা আছে ‘গিরিজ’, অকটেনকে লেখা আছে ‘অটেন’। মোবাইলের দোকানের সাইন বোর্ডে দেখা যায়, ‘কলিম ইন্টারপ্রাইজ’- তাতে আরো লেখা ‘এখান থেকে ফিলিক্স লোড, এজি লোড করা হয়। মোবাইল টু মবেল ২ টাকা। বিকাষ করা হয়।’ বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপনেও ভুল লেখা চোখে পড়ে। যেমন, ‘এখানে ঘোর ভারা দেয়া হবে। পানি, গস সুবিধাসহ।’ ছাত্রাবাসগুলোর সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘মেছ ভাড়া দেয়া হবে।’ যারা এসব বাংলা লেখে তাদের কেবল বর্ণমালা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে কাজ করতে হয়। অথচ, বানান নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। তবে যারা লিখিয়ে নিচ্ছেন, তাদেরও রয়েছে বানানে অদক্ষতা। অর্থাৎ, অসচেতন মানুষের কারণে বাংলা ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শহরকেন্দ্রিক তরুণ-যুব সমাজের মধ্যে সুন্দর এবং শুদ্ধ করে বাংলা বলার ক্ষেত্রেও অনীহা লক্ষণীয়। আসলে মাতৃভাষার মর্যাদার প্রতি তাদের যেন কোনো অঙ্গীকারই নেই! পৃথিবীর উন্নত জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির ব্যাপারে কোনো আপস করে না। কিন্তু, আমাদের দেশে রক্তরঞ্জিত বাংলা বর্ণমালার অবমাননা দেখা যায় সর্বত্র। এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা প্রয়োগে ভুলের রাজত্ব লক্ষণীয়। ভুল বানান, ভুল বাক্যের ছড়াছড়ি থাকে পোস্টের পর পোস্টে। দৃষ্টান্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম।
কেবল সোশ্যাল মিডিয়া নয় খ্রিস্টীয় বছরের প্রথম দিনে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া বিনামূল্যের বই নিয়ে ২০১৭ সালে ছিল তুমুল বিতর্ক। ছিল কবিতার বিকৃৃতি আর বানান ভুলের ছড়াছড়ি। এমনকি মুদ্রণের মান ও অলঙ্করণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল তখন। যা হোক, এসব সমস্যা সমাধান করা হয়েছিল অতি দ্রুত। কিন্তু ভুলে ভরা বাংলা ভাষার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়। আমরা মনে করি, পাঠ্যপুস্তকে কোনো ধরনের ভুল গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুদের কাছে উপস্থাপিত কবিতা বা লেখার কোনো ভুল বা বিকৃতি ভবিষ্যতেও পরিহার করতে হবে।
আসলে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে সর্বত্রই। এফএম রেডিওতে বাংলা ভাষাকে ইংরেজি স্টাইলে উচ্চারণ করা হচ্ছে। ভুলে ভরা বানানে প্রতিবাদলিপি প্রেরিত হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়; কয়েক বছর আগে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নে ভুল দেখা গেছে। পাওয়া গেছে ভুলে ভরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন নির্দেশিকাও।
সাম্প্রতিককালে অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে নিজস্ব ওয়েবসাইট। কিন্তু, এসব ওয়েবসাইটে রয়েছে অনেক ভুল। ওয়েবসাইটগুলো মানছে না বাংলা একাডেমির প্রমিত ‘বাংলা বানান রীতি’। জাতীয় সংসদের নিজস্ব ওয়েবসাইটের বাংলা সংস্করণে ইংরেজি শব্দের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার দেখা গেছে। অথচ, এসব শব্দের বাংলা অর্থ রয়েছে। আবার এসব শব্দের ব্যবহারেও রয়েছে ভুল। এসব প্রমাণ করে বাংলা শব্দ ব্যবহারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার সর্বত্র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর জন্য মূলত দায়ী আমরাই।
বিশ্বে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে অন্যতম আমাদের বাংলা ভাষা। ব্যবহারের দিক থেকে আমাদের মাতৃভাষার অবস্থান চতুর্থ। কালের বিবর্তনে আমাদের ভাষার শব্দ সম্ভার ও গদ্যরীতির দিন দিন পরিবর্তন লক্ষণীয় হলেও ভুল প্রয়োগে ভাষার মর্যাদাহানি হচ্ছে। মূলত ভুলে ভরা বাংলা ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রথমে দরকার সচেতনতা; প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করা এবং ইংরেজি শব্দের গ্রহণযোগ্য বাংলা পরিভাষা ব্যবহার আবশ্যক; উপরন্তু বিদেশি শব্দের যথার্থ পরিভাষা তৈরি এবং সেগুলোর বানানরীতি স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রযুক্তির প্রসারের যুগে বাংলাকে ইন্টারনেটের এক্সপ্রেসওয়েতে আরোহণ করতে হবে। এ জন্য সরকারি উদ্যোগ ও জনগণের উদ্যম দু’টোই জরুরি।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, কবি ও অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য