-->
প্রতিক্রিয়া

কর্মক্ষেত্রে নারী

এস ডি সুব্রত
এস ডি সুব্রত
কর্মক্ষেত্রে নারী
নারী স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং নারী জাগরণের সংগ্রামে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে পুরুষদেরকেও

‘এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল নারী দিল তাহে রূপ-রস-সুধা-গন্ধ সুনির্মল।’(নারী- কাজী নজরুল ইসলাম)

 

আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রায়ই তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। হয়রানি এমনকি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীদের কর্মস্থলে। নারী শ্রমিকরা নানা বঞ্চনা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়তই। পাচ্ছেন না তাদের ন্যায্য অধিকার। কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়ন করেন। শ্রম আইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি আইন হচ্ছে ‘নারী শ্রমিকদের ৬ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য ডে-কেয়ার, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে মালিক পক্ষ কর্তৃক। কিন্তু, বেশির ভাগ কলকারখানাগুলোতে এই আইনের প্রয়োগ নেই। নানা সমস্যা মেনে নিয়েই নারী শ্রমিকরা কাজ করে আসছেন দিনের পর দিন। নারীরা সব জায়গায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা শামীরা আকতার জলি সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন, ‘নারীরা সব সময় অবহেলিত। নারী শ্রমিকরা কলকারখানায় কাজ করছেন, অফিস আদালতে কাজ করছেন। আমাদের শ্রমবান্ধব সরকার নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সব কাজেই নারী এগিয়ে চলছে। কিন্তু, কর্মক্ষেত্রে নারীরা এমন কিছু নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন যা তারা বাইরে কাউকে বলতে পারছেন না এবং নিজের থেকেও সমাধান করতে পারছেন না।’ তিনি আরো বলেন, কোনো কলকারখানায় নারী এবং পুরুষ শ্রমিকদের সমমজুরি দেয়া হয় না। নারীরা আট ঘণ্টার জায়গায় বারো ঘণ্টা শ্রম দিচ্ছেন। তারপরও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে তারা অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। এসব বিষয় নিয়ে মালিকপক্ষের সাথে কথা বলতে গেলে শ্রমিকদেরকে নানা ধরনের ভয়-ভীতি দেখানো হয়। তাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, নারীর এই অধিকার সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করতে হলে নারীদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করতে হবে সর্বাগ্রে। যে যেখানে নির্যাতিত হচ্ছেন, সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। নিজেদের অধিকার আদায় ও সম্মান রক্ষায় নারীদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রতি সম্মান নিয়ে কাগজে-কলমে অনেক কথা বলা হলেও সার্বিক পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। আর অসম্মানের বিষয়টিও সবখানে। নারী চলাফেরা করতে গিয়ে কিংবা কর্মক্ষেত্রে অসম্মানের শিকার হচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ডা. সানজিদা আখতারের মতে, ‘আমাদের এখানে নারীর প্রতি সম্মান দেখানোর মানসিকতার যে একদম উন্নতি হচ্ছে না তা নয়, তবে তা এখনো বলার মতো পর্যায়ে আসেনি। আলাপচারিতা থেকে শুরু করে পাবলিক প্লেস- সবখানেই নারীকে অসম্মান করার প্রবণতা স্পষ্ট। এমনকি, ভাষার ব্যবহারেও জেন্ডার বৈষম্য আছে, যদিও সেখানে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন- পতিব্রতা শব্দটাকে অনেক ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, স্ত্রৈণ শব্দটিকে নেতিবাচবভাবে দেখা হয়। স্বামীভক্ত হলে ভালো, কিন্তু স্ত্রীভক্ত হলে খারাপ। নারীর চরিত্র নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ আছে, কিন্তু পুরুষদের জন্য নেই। প্রবাদ-প্রবচনেও আছে নারীকে হেয় করার প্রবণতা। যেমন- ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গরু।

নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন সন্ত্রাস, ইভটিজিং তো বাংলাদেশের একটি সাধারণ চিত্র। বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতির জন্য শিক্ষা, মূলবোধ ও সচেতনতার অভাবকে দায়ী করলেও সমাজবিজ্ঞানী, অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘শিক্ষিতরাও নারীকে হেয় করেন। তারাও নারীকে অসম্মান করেন। অনেক উচ্চ শিক্ষিত আছেন, যারা তার স্ত্রীকে ঘরের কাজের লোক মনে করেন, নির্যাতন করেন। এর কারণ দীর্ঘকাল নারীর প্রতি সম্মানের চর্চা না থাকা। এটা মুখে বলার বিষয় নয়। আমাদের সংস্কৃৃতি এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ই নারীর প্রতি অসম্মানের উপাদান আছে বছরের পর বছর ধরে।’

নারী আমাদের বোন, নারী আমাদের মা। নারী আমাদের সহযোদ্ধা। নারীর সম্মান রক্ষায় আমাদেরও দাঁড়াতে হবে নারীর পাশে। নারী স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং নারী জাগরণের সংগ্রামে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে পুরুষদেরকেও। আর এভাবেই অর্জিত হবে নারীর প্রকৃত সম্মান, সার্থক হয়ে উঠবে প্রতিটি ‘নারী দিবস’।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

মন্তব্য

Beta version