সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নারী-পুরুষের সম্পর্ক, বিশেষ করে নারীর ওপর পুরুষের নেতিবাচক মনোভাব ও নারী নির্যাতন প্রচণ্ডতম একটি বাধা। এটি একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। মাত্রা-ধারা-স্থান ও ধর্ষকের পরিচয় ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় বিশেষত যৌন নির্যাতন আজ একটি মহামারিতে পরিণত হয়েছে। জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত মহামারি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, এক সময় হ্রাস পায়; কিন্তু এরূপ সহিংসতা দেশে কেবল বাড়ছে; নিয়ন্ত্রণহীন, মানবতাবর্জিত, ঘৃণ্য এবং জঘন্যহারে। এর গতি এবং পরিণতি এমন যে, এই মহামারি বাংলাদেশকে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে দিবে না।
এই মহামারির প্রতাপ এতটাই প্রকট যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও এর হার কমেনি; বরং সবাইকে অবাক করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে, সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধকে অবজ্ঞা করে ক্রমে বেড়েই চলেছে।
এই মহামারির প্রকৃতি ও বিচার প্রক্রিয়া বলে দেয়, যেভাবে এর প্রাদুর্ভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে তা সমাজকে পুরোপুরি পঙ্গু না করা অবধি চলতেই থাকবে, যদি না অনতিবিলম্বে এর লাগাম টেনে ধরা হয়। তবে এ জাতীয় কোনো প্রতিরোধমূলক কার্যকর পদক্ষেপ অদ্যাবধি পরিদৃষ্ট নয়। এ ধরনের নির্যাতনের বিষয়টি কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কিত নয়; এর সঙ্গে মনঃজাগতিক চিন্তাভাবনা, পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, শোষণমূলক সমাজ এবং সমাজে প্রচলিত ভোগবাদী ধ্যান-ধারণার সম্পর্ক বিদ্যমান। কেন একজন পুরুষ তার ঘরে মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা থাকা সত্ত্বেও, একই রকম অন্য ঘরের মানুষদের ওপর হিংস্র হয়ে উঠবে, নির্যাতন করবে; কেন মনে মানবিক বোধ বা পাপবোধ কাজ করে না, কেন তারা এর পরিণতি ভাবে না; কিংবা কীভাবে তারা নিশ্চিত থাকে যে, তাদের কিছু হবে না- এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য হলেও তো অন্যের পরিবারের মানুষের নিরাপত্তা, তথা পুরো সমাজে নিরাপদ পরিবেশের আবশ্যকতা রয়েছে।
স্কুল-কলেজ-পরিবহন (বাস, ট্রেন), কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি স্থানে এ জাতীয় ঘটনা অহরহ ঘটছে। কয়টাই-বা পত্র-পত্রিকায় স্থান পায়। মামলা হয় তার চেয়ে ঢের কম। মামলা যা হয়, বিচার সম্পন্ন হয় তার চেয়েও আরো অনেক কম। মাঝেমধ্যে আসামিও গ্রেপ্তার হয়; তবে কিছুদিন পর তারা বেরিয়েও আসে, বেরিয়ে এসে আবার একই কাজ করে। গ্রেপ্তার হলেও শক্তি বা ক্ষমতার বলে কখনো কখনো ধর্ষিতার পক্ষের লোকজন নির্যাতনের শিকার বা তাদের পরিবারের সদস্য (যেমন, ভাই-বাবা) বা সংবাদকর্মীর ওপর চড়াও হয়।
অথচ এ দেশে নারীর সার্বিক বিকাশের মাত্রা এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। নব্বই দশক থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তথা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীদের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়। বাংলাদেশে যখন কি-না ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থান দীর্ঘদিনের, প্রতিদিন এমনকি মহামারির সময় সেখানে নারী নির্যাতনের, নির্দিষ্ট করে যৌন নির্যাতনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া ক্ষমতা ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য নারী-পুরুষ সবাইকে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি, আধা-সরকারি, স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সম্প্রদায়, জনপ্রতিনিধি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এরূপ নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
নারী নির্যাতন কেবল নারীর জন্য ক্ষতিকর তা নয়, নারীদের নিগৃহীত অবস্থায় রেখে পুরুষরা তাদের মেধা ও প্রজ্ঞার যথাযথ ব্যবহার প্রয়োগ করতে পারবে না, অর্থাৎ সমাজে তাদের যথাবিহিত ভূমিকা পালন করতে তারা সক্ষম হবেন না। একজন নারীকে যদি সর্বক্ষণ তার শরীর নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়, তাহলে সমাজে তাদের সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ কোথায়? এই পরিস্থিতিতে নারী-পুরুষ সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অবশ্যই এই মহামারি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
নারী নির্যাতন কীভাবে দেশের অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে তার একটি উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়কার একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে একজন নারীর ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কিছুদিন পর দেখা গেল কক্সবাজারে পর্যটকদের ভিড় অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কমে গেছে (দৈনিক আজাদী, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১)। করোনা ভাইরাস মহামারি যেখানে পর্যটকদের ভিড় হ্রাস করতে পারেনি; সেখানে পর্যটক নারীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় আশঙ্কাজনকভাবে ভিড় কমেছে; ফলে হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এভাবে সব খাতে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর উন্নয়নমূলক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান ও অংশগ্রহণ থেকে দেশ বঞ্চিত হবে; অথচ সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলে দেশের উন্নয়ন কয়েকগুণ বেগবান হবে। এই সত্যটি উপলব্ধি করে সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ ও সোচ্চার থাকা একান্ত প্রয়োজন। পরিমাপযোগ্য কয়েকটি উন্নয়নসূচক দ্বারা নারীর এই অধস্তন অবস্থার অবসান সম্ভব নয়। ভাবাদর্শগত পরিবর্তন ও প্রয়োজন অনুযায়ী বাস্তবিক (কঠোর আইনগত অবস্থানসহ) পদক্ষেপ এক্ষেত্রে অপরিহার্য।
লেখক : অধ্যাপক, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়
মন্তব্য