বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। পশ্চিম-উত্তর-পূর্ব তিন দিক থেকেই অসংখ্য নদনদী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। অসংখ্য নদনদী ছোট এই দেশটিকে দেয় প্রাকৃতিক সুরক্ষা। এগুলো আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবজের মতো। নদনদী দেশের মানুষের প্রাণ, হৃৎপিণ্ড। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এত এত সেবা ও সুখদানকারী নদনদী আজ দানবের পদাঘাতে ভূলুণ্ঠিত ও মৃতপ্রায়!
গতকাল সোমবার দৈনিক ভোরের আকাশ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শীতলক্ষ্যা নদের দূষণের ভয়াবহ চিত্র। প্রতিবেদনমতে, ভয়াবহ দূষণে ‘মৃত্যুর পথে’ শীতলক্ষ্যা নদ!কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক পানি, বর্জ্যসহ নারায়ণগঞ্জ নগরীর আবর্জনায় শীতলক্ষ্যা তার রূপ হারিয়েছে। এক সময় স্বচ্ছ পানি থাকলেও এখন তা কালো আর দুর্গন্ধযুক্ত। ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়ে স্রোতস্বিনী শীতলক্ষ্যা এখন প্রায় মৃত্যুর পথে।
ড্রেন ও ক্যানেলের মাধ্যমে শিল্পকারখানা, ডাইং ফ্যাক্টরির রঙিন-কালো পানি নদীতে পড়ছে। আশপাশ এলাকার মানুষের ফেলা বর্জ্যে ক্রমেই দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা। এর ফলে পরিবেশের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়ছে স্থানীয় জনগণ। তাদের অভিযোগ, দুর্গন্ধের কারণে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটা যায় না। আর যারা খেয়া পার হন, তাদের নাকে রুমাল চেপে ধরে যেতে হয়। এ নদীর পানি খাওয়া কিংবা ব্যবহার অযোগ্য।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বলছে, কারখানাগুলোর রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলা, ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) থাকলেও তা ব্যবহার না করা এবং শহরের বর্জ্যরে কারণে শীতলক্ষ্যা এখন মৃত্যুর পথে। ফলে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব যেমন মারাত্মক সংকটে পড়েছে, তেমনি কালো রঙের পানি ও বিদঘুটে গন্ধে আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এখন শীতলক্ষ্যা নদকে বাঁচাতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কঠোর হতে হবে। পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে নামমাত্র জরিমানাতে যেন তাদের দায়িত্ব শেষ না হয়।
জানা যায়, শীতলক্ষ্যা নদকে ঘিরে প্রায় ৪শ বছর আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর হিসেবে গড়ে ওঠে প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ। অর্ধশত বছর ধরে নদীর আশপাশে গড়ে ওঠে শিল্প-কারখানা। ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ ও জলজ প্রাণীর বাস উপযোগী। অনেকে এ নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। এ নদীর পানি ব্যবহার করতেন রান্নাসহ গোসলের কাজে। তখন নদীর দুই পাড়ে প্রাকৃতিক সমৃদ্ধিই ছিল শত কিলোমিটার দীর্ঘ। তবে সেই শীতলক্ষ্যার অবস্থা এখন মুমূর্ষু! কুচকুচে কালো আর উৎকট দুর্গন্ধের পানি ব্যবহার তো দূরের কথা, নদীপথে চলাচলই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে নদী দখলদারের সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৪৯। ২০১৯ সালে নদী কমিশনের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো নদনদীর অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছিল। তখন সারাদেশে দখলদারের সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৩৯০। উচ্ছেদও করা হয় ১৮ হাজার ৫৭৯টি দখল। এর পরও ওই বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সারাদেশে নতুন দখলদারের সংখ্যা পাঁচ হাজার বৃদ্ধি পায়।
আশার কথা হলো, দূষণে-দখলে মৃতপ্রায় নদনদী রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। ২৫ বছর মেয়াদি ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
দেশে নীতি, আইন, পরিসংখ্যান সব আছে। দরকার শুধু যথাযথ প্রয়োগ। শুধু শীতলক্ষ্যাই নয়, দেশের প্রতিটি নদীকে রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে আন্তরিক হতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
“অসংখ্য নদনদী ছোট এই দেশটিকে দেয় প্রাকৃতিক সুরক্ষা। এগুলো আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবজের মতো। নদনদী দেশের মানুষের প্রাণ, হৃৎপিণ্ড। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এত এত সেবা ও সুখদানকারী নদনদী আজ দানবের পদাঘাতে ভূলুণ্ঠিত ও মৃতপ্রায়!”
মন্তব্য