প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যের অপূর্ব লীলাভূমি সুন্দরবন। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজখ্যাত এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আমাদের গর্বের প্রতীক। সুন্দরবনের বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রাহরিণসহ এই সুন্দরবনের সম্পদ প্রাচুর্য এবং জীববৈচিত্র্য আমাদেরকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। ফলে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক ও দর্শনার্থী সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আগমন করে থাকেন।
সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। এ বনের বৃক্ষকূলের মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দরী বৃক্ষ। এ বনে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী বৃক্ষ জন্মে বলেই এ বনকে সুন্দরবন নামকরণ করা হয়েছে। সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ বন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো (UNESCO) ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ বিরল সম্মাননা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা।
বিচিত্র সব প্রাণীর বাস সুন্দরবনে। সুন্দরবনে প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। সুন্দরবনের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবী বিখ্যাত, যার একমাত্র আবাসস্থল এই সুন্দরবন। ২০০৪ সালের হিসাব মতে, সুন্দরবন প্রায় ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘের আবাসস্থল। সুন্দরবনে পর্যটকদের আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে মায়াবি চিত্রল হরিণ।
বন বিভাগের পাশাপাশি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বন্যপ্রাণী রক্ষায় যথাযথ তৎপর থাকলেও কিছু অসাধু চোরা শিকারি চক্র বিভিন্ন কৌশলে এসব বন্যপ্রাণী শিকার করে পাচার করছে। ২০১১ সালের এক সরকারি প্রতিবেদনে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩০০টি। এছাড়া সুন্দরবনে রয়েছে বানর, বনবিড়াল, লিওপার্ড, শজারু, বন মহিষ, উদ, কুমির, সাপ, টিকটিকি এবং বন্য শূকরসহ অনেক বিচিত্র প্রাণী।
বর্তমান সরকার সুন্দরবনের এই অমূল্য প্রাণীসম্পদ রক্ষার্থে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পাঁচার রোধে আইনশৃংখলা বাহিনী, বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য সফল অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখছে। ২০১৫ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং সচেতনতা সৃষ্টির কাজে বিশেষ অবদান রাখায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক র্যাব ফোর্সেসকে ‘Bangabandhu Award For Wildlife Conservation-2015’ প্রদান করা হয়।
সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য এক বিরাট আয়ের উৎস। সুন্দরবন দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার হিসেবে স্বীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। কিন্তু একদা জলদস্যু ও বনদস্যুদের অভয়ারণ্য ছিল সুন্দরবন। জেলে, বাউয়ালি, মৌয়াল এমনকি বনরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও দস্যুরা ছিল ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’। তাদের উৎপাত ঠেকাতে সরকার ২০১২ সালে র্যাব ফোর্সেসের মহাপরিচালককে প্রধান করে সুন্দরবনের দস্যু দমনের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠিত হয়। টাস্কফোর্স গঠনের ফলে বেগবান হয় সুন্দরবনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান।
র্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও বন বিভাগের সক্রিয় প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের দস্যুমুক্তকরন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সর্বমোট ৩২টি বাহিনীর ৩২৪ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪২৬টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। গত ০১ নভেম্বর-১৮ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনকে দসু্যুমুক্ত ঘোষণা করেন। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণার মাধ্যমে সুন্দরবনের প্রায় ৪০০ বছরের দস্যুতার অবসান ঘটে।
শুধু তাই নয়, আত্মসমর্পণকৃত দস্যুদের অতিদ্রুত সামজের মূল শ্রোতধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আনতে ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার তাদের এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এমনকি র্যাবের পক্ষ থেকে প্রত্যেক আত্মসমর্পণকৃত দস্যুকে অর্থ সাহায্য, শীতবস্ত্র ও মোবাইল ফোন প্রদান করা হয়। গত ০১ নভেম্বর-২১ র্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক আত্মসমর্পণকৃত ১০২টি দস্যু পরিবারকে নির্মিত ঘর, ৯০টি পরিবারকে নির্মিত মুদি দোকান, ১১৪টি পরিবারকে বাছুরসহ গাভী, ০৮টি পরিবারকে ইঞ্জিনসহ নৌকা এবং ১২টি পরিবারকে জালসহ নৌকা প্রদান করা হয়। সর্বমোট ৩২৬টি পরিবারকে পুনর্বাসন সহায়তা দেওয়া হয়। তাছাড়া বিভিন্ন উৎসব, ঈদ, পূজা ও করোনাকালীন সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে র্যাব ফোর্সেস।
ইদানীং সুন্দরবনে বাঘ, হরিণ ও পশুপাখি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুন্দরবন উপকূলীয় লোকজনসহ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী ও পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাব সুন্দরবনের জলদস্যু, বনদস্যু ও পাচারকারী দমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যু, বনদস্যু ও পাচারকারীর অপতৎপরতা রোধকল্পে এবং ওই এলাকায় র্যাবের উপস্থিতি নিশ্চিতকল্পে নিয়মিত হেলিকপ্টার পর্যবেক্ষণ অপারেশন (ঐবষর জবপপব) পরিচালনা করা হচ্ছে। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত রাখার পাশাপাশি ফলপ্রসূ অভিযান পরিচালনার জন্য সুন্দরবনের দুবলারচর এলাকায় র্যাবের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। বর্তমানে সুন্দরবনে আরো দুটি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য প্রস্তাবনা প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়াও দস্যুমুক্ত সুন্দরবন বাস্তবায়নের জন্য সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিসহ নিয়মিত টহল ও আভিযানিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বনজ সম্পদ, কর্মসংস্থান, প্রাণী ও উদ্ভিদের বিচিত্রতা, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল ও বিপুল প্রাকৃতিক অক্সিজেনের জোগান দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এব বিভিন্ন প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে সুন্দরবনের ভূমিকা অপরসীম। এই প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত রাখা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। আইনশৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি আমাদের সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই পারে একমাত্র সরকার কর্তৃক ঘোষিত সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত রাখতে।
লেখক : অধিনায়ক, র্যাব-৬, খুলনা
মন্তব্য