পবিত্র রমজান মাস আসন্ন। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠার শব্দ শোনা যায়। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে চারদিকে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে খবরের কাগজের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছে, ‘রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে’। এই রকম খবরে প্রথম দিকে মনে একটু আশা জাগে, যেন সত্য হয়! পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে আসে, এটা তো প্রতি বছরই শুনি। বাস্তবটাও তো জানি। এ রকম সংবাদ কিংবা উপর মহলের আশ্বাস প্রতি বছরই শুভেচ্ছার মতো পাওয়া যায়, প্রতি বছরই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়; তবে তা অবশ্যই মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। কারণ ক্রয় ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে পণ্য পাওয়ার সুযোগ নেই; অন্তত, সাধারণ মানুষের জন্য। বিশ টাকার জিনিস ১০০ টাকা হলেও মানুষকে কিনতে হয়; কোনো পণ্য আগে যদি এক কেজি কেনা যেত, রমজান বা যে কোনো উৎসবের আগে আগে গুনে গুনে ৫-১০টা করে কেনা হবে; কম খাবে। তবু কেনার ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। কম খেলে কিচ্ছু হয় না; বেশি খেলে গলা ধরে; ওজন বাড়ে। এবার না হয় পাঁচটা করে পেঁয়াজ কেনা হবে; গত বছর যদি তিন কেজি ছোলা কেনা হয়, এবার হয়তো দুই কেজি কেনা যাবে। অর্থাৎ পরিমাণ কমালেও কেনা বন্ধ হবে না। তাই বলা যায়, আসলেই তা ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। তাছাড়া ভোজনরসিক বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের জন্য এমনটাই হয়তো দরকার!
যারা বেশি পরিমাণে কিনতে পছন্দ করেন, তারা না-হয় গুণগতমানের প্রশ্নে কিছুটা ছাড় দিয়ে তুলনামূলকভাবে কম দামি জিনিস কিনবেন। ছাড় তো দিতেই হবে; হয় দাম কিংবা মান। তাই বলা যায়, দাম যাই-ই হোক না কেন, তা অবশ্যই ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বলে কেনাকাটার অভাবে না খেয়ে থাকার কারণে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। এটাই হয়তো আমাদের জন্য সব থেকে স্বস্তির; এবং একমাত্র সান্ত¡নার বিষয়। কেবল নিয়ন্ত্রণ হবে। তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এবং তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কারোর নেই কিংবা আদৌ কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন কি-না সে ব্যাপারে জনগণের মনে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সুযোগ নাই; কারণ বিষয়গুলো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই রকমভাবে চলে আসছে। বিশেষ করে যখন রাজনীতি এবং ক্ষমতা ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট ধনপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তখন মানুষ এসব বিষয়ে আর প্রশ্ন করতেও চায় না।
তবে এই গোলোকায়নের যুগে মানুষ সবই জানে, সবই বোঝে; যদিও কিচ্ছুই করার নেই। এখন গ্রামের মানুষও জানেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেকোনো বড় ধরনের উৎসবের আগে নিত্যপণ্যের দাম, শৌখিন জিনিসপত্রের দাম এবং পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যাদির দাম উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকে; বিশেষ ছাড় থাকে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মানুষ বিভিন্ন সেলের (Sale) অপেক্ষায় থাকে। বিভিন্ন উৎসবের আগে অনেক দেশে ‘বিশেষ বিশেষ সেল’ দেয়া হয়। বেশিরভাগ মানুষ, এমনকি ধনীরাও ওই ‘সেলে’র অপেক্ষায় থাকে এবং বেশিরভাগ মানুষই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, জুতা, জামাকাপড় সবকিছু সাধারণত ‘সেল’ থেকে কিনে থাকে। কোনো কোনো দেশে সারা বছর ধরে ‘সেল’ অব্যাহত থাকে; একেক এলাকায় একেক সময়; একেক মার্কেটে একেক সময়; পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যের ওপর।
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে দেশে উৎসব হোক কিংবা দুর্যোগ; জিনিসপত্রের দাম অন্য সময় অপেক্ষা বাড়বে; এটা একদম অবধারিত। মালিক পক্ষ দয়াপরবশ হয়ে যে পর্যন্ত বাড়াতে চান সেই পর্যন্তই তা বাড়বে। কমানোর সাধ্যি কারো নাই। ঘোষণা দিয়ে, না দিয়ে; এবং এমনকি কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা উপেক্ষা করেও আগে থেকেও বাড়ানোর এক অন্তিম ক্ষমতা তাদের। নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা নেই কারোর।
দেখা যায়, যে সময়টাতে মানুষের সংকট প্রকট, সে সময়ে যে যে পণ্য অপরিহার্য, সেগুলোর দাম হাতের নাগালের বাইরে যাবেই। প্রতিদিন খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হবে নিত্য/অনিত্য পণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে; কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হয় না। দাম তার নিজের ইচ্ছার বাইরে কারো কথায় কমে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতি এখন এমন স্বাভাবিক ও সহনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, এটার প্রতিকার অপেক্ষা, কোনো পণ্যের দাম কত এবং কোন পণ্য কতটুকু কেনা যাবে সেদিকেই মানুষের মূল আগ্রহ। এ লক্ষ্যে সংবাদপত্রগুলো নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমসমূহে আজকাল বাজারের জিনিসপত্রের দাম নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য বিশেষ প্রতিনিধিও থাকে। কারণ রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, বিনোদন বা খেলাধুলার মতো জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা; যা মানুষ জানতে চায়, তার সামর্থ্যরে সাথে সঙ্গতি রেখে কেনাকাটা করার জন্য, খাদ্যাভাস পরিবর্তনের জন্য। এ মাসে এক কেজি পেঁয়াজ কিনবে নাকি ১০টা কিনবে; কিংবা এই শীতে সবজি খাবে, কী খাবে না। বেঁচে থাকলে পরের বার চেষ্টা করা যাবে!
বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার বাকবিতণ্ডা নিয়েও টিভি মাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়; তবে দাম বৃদ্ধিতে অভিযোগ বা প্রতিকার চেয়ে আজকাল মানুষ কম কথা বলে। কারণ মানুষ জানে এসব বলে আর লাভ নেই। যারা মালিক, তারাই তো সিদ্ধান্ত নেন। তাই সাধারণ মানুষের ভিন্ন অবস্থান নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। সাম্প্রতিক সময়ে ২০ টাকার জিনিস ১০০ টাকা হলেও মানুষ আর বেশি উচ্চবাচ্য করে না। দাম বাড়ছে তো বাড়ুক; একসময় নিশ্চয় কমবে; কিনতে না পারলে কিংবা কম কম খেলে তো আর মানুষ মরে না।
বস্তুত, দিনের পর দিন মানুষ এসব অনিয়ম দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং বুঝতে পেরেছে এসব বিষয়ে কথাবাত্রা বলা অর্থহীন। যারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন, যারা পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের মূলধনকে বাড়াচ্ছেন মানুষকে শোষণ করে, সে শোষকদের মানুষ চেনেন। তারা ক্ষমতাবলয়ে অবস্থান করেন কিংবা ক্ষমতাবলয়ের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা ওতপ্রোত। তাই মানুষ দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। চালের দাম বেড়ে গেলে আলু খাবে, আলুর দাম বেড়ে গেলে কচু খাবে, বাঁশ খাবে। মাঝে মাঝে ভোক্তা অধিকার সংগঠনের কথা টেলিভিশনে দেখা যায়, সংবাদপত্রে ছবিও প্রকাশিত হয়। তাদের দোষ দিয়েও লাভ নাই। তাদের প্র্রচেষ্টা থাকলেও, দ্রব্যমূল্যের ওপর কারো কোনো অধিকার নেই; নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবল নিত্যপণ্যের দাম কেন, বাড়ি ভাড়া, বাস ভাড়া সবই বাড়ে এই দেশে। এক অদ্ভুত ব্যাপার, যখন যেটার সংকট বা প্রয়োজন, তখন সেটার দাম বাড়ে। এই দেশে ৫০ টাকার হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম ১০০ টাকা হয়; ১ টাকার প্যারাসিটামল ৫ টাকা হয়ে যায়; ১০০ টাকার বাস ভাড়া ১৫০ টাকা হয়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত পরিবেশে বাড়–ক। খালি একটা কথা। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এই দেশে পবিত্র রমজান কিংবা ঈদের আগে আগে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কী কারণ? সাধারণ মানুষের মনে একটি প্রশ্ন- কেন প্রতি বছর রমজান মাসে ছোলা, দুধ, খেজুর এমনকি মুড়ির দাম বাড়ে? মধ্যপ্রাচ্যের কথা শুনতে পাই, সেখানে রমজান মাসে নামমাত্র মূল্যে খেজুর, ফল, জামা-কাপড়-সহ সব পণ্য বিক্রি হয়; অথচ বাংলাদেশে ঘটে তার উল্টো।
তাই, এ দেশে লুণ্ঠনকারী আর সাধারণ মানুষের কাছে উৎসবের তাৎপর্য এক নয়। যেকোনো উৎসব বা দুর্যোগে পুঁজিপতিদের লাভের ওপর লাভ; আর সাধারণ মানুষকে তখন পরিমিত থাকতে হয়। তাই রোজার মাসে বাঙালি মুসলিমকে দিনেরাতে সবসময় পরিমিত থাকতে হয়; প্রথমত সিয়াম সাধন বা রোজা রাখার মাধ্যমে; আবার জিনিসপত্র কেনাকাটায় সংযম সাধনের মাধ্যমে। দুর্যোগের সময়ও তাই। তাই পুঁজিপতিদের কাছে উৎসবও যা, দুর্যোগও তা; সবকিছুতে লাভ। তাই তো দেখা গেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে। তা সত্ত্বেও বলা যায়, বাংলাদেশ সত্যি উন্নতির চরম মাত্রায়। না হয় মানুষ কিভাবে টিকে থাকে! আয়ের সাথে ব্যয়ের তুলনা করলে বাংলাদেশের জীবিকা নির্বাহ খরচ যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা বেশি, তবু তো বাংলাদেশ বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে।আচ্ছা! বাংলাদেশে জিনিসপত্রের এই যে হঠাৎ হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি এটাকে অর্থনীতির ভাষায় কী বলে? মানে কোনো সূচক বা নির্দেশক দিয়ে বিচার করা যায়? নাকি এখানেও তা বিচারের সীমানার বাইরে? তবে সাধারণভাবে বলা যায়, যতদিন না বাজারদর নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে ততদিন বাংলাদেশের মানুষকে এই অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করতে হবে। এর বিকল্প নেই। তাই হয় ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে, লোভ সামলাতে হবে, কিংবা ভোগ সামলাতে হবে; এটাই আপাত উপায়।
লেখক : অধ্যাপক। নৃৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য