-->
জামাল নজরুল ইসলাম

ধ্রুপদি সংগীতের মগ্নতায় কাজ করে গেছেন

আসিফ
আসিফ
ধ্রুপদি সংগীতের মগ্নতায় কাজ করে গেছেন
প্রয়াত জামাল নজরুল ইসলাম

১৯৮৭ সালেমির পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত স্পেস টাইম অ্যান্ড গ্রাভিটেশন নামে একটা বই আমার হাতে আসে। বইটা না পেলে সমতল জ্যামিতির নাটকীয় ইতিহাস নিয়ে এত কৌতূহলী হতাম না। সমান্তরাল সরলরেখা নিয়ে পুত্রের কাছে লেখা পিতার সেই অসাধারণ চিঠিটার কথা আমি জানতাম না। কিভাবে স্বীকার্য ব্যবস্থায় একটা বিবৃতির সামান্য বিচ্যুতিতে পুরো কাঠামোটার পরিবর্তন ঘটে যায় তা ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল আমাকে। ওই বইয়ের রেফারেন্স ধরে আরো কয়েকটি বই ঘাটলে, জামাল নজরুল ইসলামের ‘আলটিমেট ফেট অব ইউনিভার্স’ নামটা দেখি। আমার কৌতূহল জাগে এই মানুষটার প্রতি। একদিন এক সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ পৌর পাঠাগারের দোতলা অডিটোরিয়ামে যাই। দেখি, ৬০ বছরের এক মানুষ তন্ময় হয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। একটু পরে বুঝলাম নক্ষত্রের জন্মমৃত্যু নিয়ে কথা বলছেন। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতোই ধ্রুপদী রীতিতে ধীরে ধীরে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করছেন তিনি: ‘শকওয়েভে ঘনীভূত হয় আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণা- বেশিরভাগই হাইড্রোজেন। মহাকর্ষীয় শক্তি তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে। জন্ম নিতে থাকে নক্ষত্রের ভ্রমণ।’ তিনি যে ধ্রুপদী রীতিতে কথা বলছিলেন তা শোনার স্থিরতা ওই দর্শকদের সামগ্রিকভাবে না থাকলেও এক ধরনের মুগ্ধতা দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে লক্ষ করছিলাম। নারায়ণগঞ্জ শ্রুতি সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠানটি হচ্ছিল। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের একজনকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, উনি হলেন জামাল নজরুল ইসলাম। আপন মনে ভাবি, কতটা পথ হাঁটার পর এই মগ্নতা আসে!

এরপর তার সঙ্গে দেখা হয় ২০০৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মুসলিম হলে, আমার এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে। তিনি উদ্বোধন করে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রায় ১৩শ’ লোক টিকিট কেটে এসেছিল। একটি বিজ্ঞান বক্তৃতায় এত মানুষ দেখে বেশ আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘দেশের জন্য এটা শুভ। সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানকে প্রবাহিত করতে পারলেই সমাজ এগিয়ে যাবে।’ তাঁকে শেষবার দেখি এনায়েতপুরে যমুনার তীরে মহাকাশ উৎসবে। একজন মহাবিশ্ব ধ্রুবক নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এমন তন্ময়তা নিয়ে আলোচনা করলেন যেন মনে হয় ক্যাম্ব্রিজের বন বিথিকায় আলোচনায় মগ্ন। প্রত্যেকটা মানুষের প্রশ্নই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতো। সাংস্কৃতিক জাগরণের অগ্রপথিক ওয়াহিদুল হক তাঁর কথা প্রায়ই বলতেন; বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশন ধারণা নিয়ে অদ্ভুত সব আলোচনার কথা। আধুনিক প্রযুক্তির কোনোকিছুই তিনি ব্যবহার করতেন না। ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফুসফুসের সংক্রমণ ও হৃদরোগেই চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে ৭৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু।

জামাল নজরুল ইসলামের রচিত পঞ্চাশটিরও বেশি গবেষণাপত্র রয়েছে। গবেষণাপত্রগুলো অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান জার্নালে। তার গবেষণা প্রবন্ধগুলো ফ্রেড হয়েল, স্টিফেন হকিং, মার্টিন রিজের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে জমা দিয়েছেন।

পঞ্চাশ বছরের বৈজ্ঞানিক জীবনে তিনি ধ্রুপদী সব বিজ্ঞান ধারার ওপর কাজ করে গেছেন। এই মানুষটির লেখা দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স (১৯৮৩) বইটি আট-নয়টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এটি বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে থাকবে। বইটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ, সার্বোক্রোয়েটসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। পৃথিবীর সব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বইটি পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়। বইটির পেপারব্যাকও বেরিয়েছে ২০০৯ সালে। কৃষ্ণ বিবর (বাংলায় ১৯৮৫)- বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইটি দেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ১৯৯৮ সালে তিনি ইতালির আব্দুস সালাম সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমির লেকচার পদক লাভ করেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০১ সালে একুশে পদকে ভূষিত করেন।

১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব কার্ডিফে আবার আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। ৪০ বছরের মতো এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কেউ আইনস্টাইন উত্থাপিত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করেন নাই বলে তার কাছ থেকে জানা যায়। তার অবদানকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিদ্যা, কনফর্মাল মহাকর্ষ তত্ত্ব, মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ, মহাজাগতিক ধ্রুবক লামডা।

১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনোমিতে কর্মরত ছিলেন। ষাটের দশকে কেমব্রিজে স্বয়ং পল ডিরাক তাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্লাস নিতে দেন, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব (ফিল্ড থিওরি) পড়েছেন জন পলকিংহর্নের কাছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনা শেষে ১৯৮৪ সালে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন। সেখানে তিনি রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস নামে একটি বিশ্বমানের গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে আবদুস সালাম এই কেন্দ্রটির উদ্বোধন করেন। ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জামাল সুনামের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।

প্রতিদিন কর্মস্থলে যেতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ট্রেনে প্রবল ভিড় উপেক্ষা করে; যে ট্রেনে একবার গেলে অনেককেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়Ñ কোনোভাবেই এই বাহনে নয়। এখানে নানা আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যেও জে. এন. ইসলাম দ্রুত আন্তর্জাতিকমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস কেন্দ্রটি গড়ে তোলেন। এটার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের পরিসীমা বাড়াতে চেয়েছেন তিনি। এখানে সেমিনার ওয়ার্কশপ ও কনফারেন্স করেছেন, কখনো গণিত, পদার্থবিদ্যা; কখনো বা অর্থনীতির ওপর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী, আপেক্ষিকতত্ত্ববিদ এবং বিশ্বসৃষ্টি তাত্ত্বিকরা অনেক সময় কাটিয়ে গেছেন। যেখানে রজার পেনরোজ, প্রফেসর সালাম, অমর্ত্য সেন, জিম মার্লিস, জাপানের আরাকিসহ অনেক নোবেলজয়ী পণ্ডিতের সমাগম ঘটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে তিনবার এসেছেন কৃষ্ণগহ্বর কিভাবে গঠন হয় তা গাণিতিকভাবে দেখানোর পথিকৃত রজার পেনরোজ। যেসব বিজ্ঞানীকে দেখতে পাওয়া দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। তারা আসা যাওয়ার মধ্যে থেকেছেন, কেউ জানতেও পারেননি। গণমাধ্যমগুলোও এগুলো জানাতে পারেনি বা দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে গুরুত্ব পায়নি। ফলে সমাজও জানতে পারেনি।

বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম বলেছিলেন, এশিয়া থেকে আর কোনো ব্যক্তি নোবেল পেলে তা জামাল নজরুল ইসলামই প্রথম পাবেন। পেলে ভালোই লাগত। কিন্তু আমাদের চিন্তাধারায় এটা একটা সমস্যা যে, সবসময় পুরস্কারের মাপকাঠিতে একটা মানুষের মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়। পুরস্কার বা সম্মাননা কাজের ক্ষেত্রে নানাভাবে সুবিধা এনে দেয় এ কথা ঠিক। তবে, এটা একজন মানুষের কাজের মূল্যায়নের নিখুঁত মাপকাঠি হতে পারে না; কেননা বহু যোগ্য মানুষই এর বাইরে থেকে যায়। প্রত্যেকেই যেহেতু স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন, তাই কাজের ভিত্তিতেই মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। জামালের চিন্তাধারার গভীরতাকে বোঝার জন্য তার রচিত বই এবং প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধমালাকেই বিবেচনায় আনতে হবে। এটা যৌক্তিক পথও। দুটি ক্ষেত্র যেমন: প্রথমটি, ধ্রুবহারে নয়, ত্বরিত হারে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মিল্কিওয়ে, অ্যান্ড্রোমিডা ছাড়া বেশিরভাগ গ্যালাক্সি আমাদের দিগন্ত থেকে উধাও হয়ে যাবে- ধারণাসমূহ ছাড়া জামালের গবেষণা কর্মগুলোর বেশিরভাগই অপরিবর্তিত থাকবে। আওয়ার ফাইন্যাল সেঞ্চুরির লেখক ও বিজ্ঞানী মার্টিন রিজও তাই মনে করেন।

গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি কখনো সমাজ ও জনবিচ্ছিন্ন হননি। বিজ্ঞানী জোহানস কেপলারের সাঙ্গীতিক ঐক্যতানে তা মিলিয়েছেন। সম্ভবত আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণবিচ্ছিন্ন রূপ তাকে নির্জনবাসে ঠেলে দিয়েছিল। তারপরও অত্যন্ত সমাজসচেতন এই বিজ্ঞানী গবেষণা ও জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি মাতৃভূমির প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছেন। ১৬ মার্চ জামাল নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস ছিল; রইল গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক : বিজ্ঞান বক্তা এবং সম্পাদক, মহাবৃত্ত

মন্তব্য

Beta version