শেষ হলো বইমেলা। বাংলা একাডেমির তথ্য মোতাবেক মেলায় সর্বমোট বই বিক্রি হয়েছে কমপক্ষে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে মেলায় বিক্রি হয়েছিল মাত্র তিন কোটি ১১ লাখ টাকার বই। তার আগের বছর ২০২০ সালে বইমেলায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। বইমেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের তথ্য সম্পর্কে বাংলা একাডেমি জানায়, বইমেলায় এবার ৩ হাজার ৪১৬টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৯০৯টি বই মানসম্মত। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯১৯টি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বছর মানসম্মত বই ছিল ৭৫১টি, শতকরা ১৫ শতাংশ ছিল মানসম্মত। এবার মোট প্রকাশিত বইয়ের ২৬ শতাংশ মানসম্মত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের তুলনায় এবার ভালো মানসম্মত বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে মানহীন বইয়ের সংখ্যা এখনো প্রচুর।
আরো অভিযোগ রয়েছে পাইরেসি বা চৌর্যবৃত্তির। বইমেলা বা নীলক্ষেতকেন্দ্রিক পাইরেসির ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একজন লেখকের বই অন্য লেখকের নামে প্রকাশ। দ্বিতীয়ত, প্রকাশিত কোনো রচনা, প্রবন্ধ বা কবিতার অংশবিশেষ চুরি করে অন্য কোনো নামে বই প্রকাশ। তৃতীয়ত, প্রচ্ছদ পরিবর্তন করে পুরো গ্রন্থটি অন্য নামে প্রকাশের মাধ্যমে পাইরেসি করা হয়। ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় বিদেশি পাইরেটেড বই বিক্রির কারণে টাস্কফোর্স ২০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করেছিল। এ সম্পর্কে কপিরাইট ও আন্তর্জাতিক গ্রন্থ দিবস-২০১৩ এর প্রাক্কালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রথিতযশা কবি (বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক) মুহম্মদ নুরুল হুদা বলেছিলেন, বইমেলায় গড়ে তিন হাজারের মতো বই প্রকাশ হয়ে আসছে। এর অধিকাংশ মেধাস্বত্ব অনুসারে যথার্থ অর্থে বই কি-না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। টাকা থাকলেই একজন ব্যক্তি গদ্যে বা পদ্যে তিন ফর্মার বই ছেপে গ্রন্থকার হয়ে যাচ্ছেন। কেউ অন্যের রচনা সংকলন করে নিজের নামে ছেপে দিচ্ছেন। এই প্রবণতাকে ন্যূনতম নিয়মে আনা জরুরি।
লক্ষণীয়, চৌর্যবৃত্তি শুধু বিদেশি একাডেমি বইয়ের ক্ষেত্রেই ঘটছে না, দেশীয় একাডেমিক ও সৃজনশীল গ্রন্থের ক্ষেত্রেও সমভাবে ঘটছে। দ্বিতীয়ত, শুধু ছাপা অক্ষরেই নয়, অনলাইনের পাইরেসির ফলেও অনুমতিবিহীন কপিকরণ ঘটছে বিভিন্ন মাত্রায়। তবে বাংলাদেশে খ্যাতনামা বিদেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থের পাইরেসিকে কেউ কেউ একাডেমিক শিক্ষার স্বার্থে ও এসব বইয়ের বাজার বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হওয়ায় অনেকটা মেনে নিয়েছেন। বাংলাদেশের লেখক-প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত বই যখন বাজারে অননুমোদিতভাবে প্রকাশ হতে থাকে তখন গ্রন্থটির নিজস্ব চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পাইরেটেড কপির মূল্য কম হওয়ায় তা বিক্রি হতে থাকে অস্বাভাবিকভাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হন মূল লেখক এবং প্রকাশক। পাঠক কেন নকল এবং পাইরেটেড বই কেনেন তার কতিপয় চমকপ্রদ ও মজার ব্যাখ্যা বা যুক্তি রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পাঠকের মনোগত ধারনার বিশ্লেষণ এটি। একজন পাঠক মূল বই নাকি পাইরেটেড বই কিনবে, গুনগত মানসম্পন্ন নাকি নিম্নমানের বই কিনবে, প্রচলিত আইন অনুসরণ করবে নাকি অবৈধ পন্থায় কম দামে নকল বই কিনতে রাজি থাকবে- এসব বিষয়ের ওপর পাইরেটেড বই বেচাকেনা হবে কি-না তা নির্ভর করবে। উদাহরণস্বরূপ আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নীলক্ষেত বইয়ের বাজারে যায় দেখব পাইরেটেড বইয়ের সিংহভাগ ক্রেতাই শিক্ষার্থী। কারণ একটাই, অত্যন্ত অল্প মূল্যের এসব বইই তাদের পড়াশোনার মাধ্যম।
একজন পাঠকের মানসিক বিবেচনা ও মূল্যবোধও পাইরেসিকে উৎসাহিত করে। কোনো পণ্য বা বই ক্রয়ের আগে আমরা নিজেরা কি এসব বিবেচনা করি? যে বই বা গান কম্পিউটারের এক ক্লিকেই সামনে ভেসে ওঠে, পড়তে বা শুনতে পারি তার জন্য অর্থ খরচ করব কেন। এমন অনেক প্রয়োজনীয় বই বা মুভি সফটওয়্যার আছে যা এ মুহূর্তে জরুরি অথচ বৈধভাবে দেশে পাওয়া যায় না সেক্ষেত্রে সহজেই পাওয়া যায় এমন কোনো বই বা মুভি আমরা সংগ্রহ করব না কেন। একটি ডাটাবেজ বা সফটওয়্যার যার প্রকৃত মূল্য অনেক কিন্তু এর সীমিত ব্যবহারের জন্য কম মূল্যের পাইরেটেড কপির জন্য স্বাভাবিকভাবেই একজন পাঠক না দর্শক আগ্রহী হয়ে ওঠে। আরো একটি অভিনব যুক্তি সেটা হচ্ছে পাঠক বা ব্যবহারকারী ভেবে নেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অনেক লাভ করেছে, তাই নকল বই কিনলেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তারা আরো বলেন, একজন শিক্ষক যখন পাইরেটেড বই অনুসরণ করছেন সেক্ষেত্রে তাদের ব্যবহারে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং তারা উৎসাহিত হয়, বন্ধুরা মিলে একটি বই কিনে ভাগাভাগি করে পড়ে। তবে শুধু পাঠকের ওপর দায়ভার চাপিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। এখানে সব পক্ষের নেতিবাচক অংশগ্রহণের কারণে আজ প্রকাশনা শিল্পের দুর্দিন। প্রকাশকদের ক্ষেত্রে কেউ কেউ প্রকাশ করছেন পাইরেটেড বই। নিজেরাই বিক্রেতা সেজে বা অন্য কারোর মাধ্যমে পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন বাহারী প্রচ্ছদ সর্বস্ব বই, শুধুই আর্থিক সুবিধার জন্য।
প্রকাশক, বিক্রেতা ও পাঠক সব পক্ষই কম-বেশি আর্থিক কারণে মানহীন এসব বই কেনা-বেচায় সহায়তা করছেন, যা অনৈতিক। মেধা সম্পদের এহেন চৌর্যবৃত্তিতে বাংলাদেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশক, পাঠক হতাশায় নিমজ্জিত। মেধাবী মানুষের সৃষ্টিশীলতা এই চৌর্যবৃত্তির কারণে আশাহত হয়, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়, ব্যাহত হয় সাংস্কৃতিক আর অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। এরপর লেখক সম্মানীর বিষয়। মনে করি ৫ হাজার বইয়ের জন্য ৫ হাজার পাণ্ডুলিপি বা কন্টেন্ট বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর বইমেলায় এসেছে। প্রতিটি লেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট হারে রয়্যালটি বা সম্মানী পেয়ে থাকেন পান্ডুলিপি রচয়িতা বা লেখক। কপিরাইট অর্জনের মাধ্যমে পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে প্রকাশ, কপিকরণ ও বিতরণের অধিকার পেয়ে থাকেন প্রকাশক। বিনিময়ে লেখক পান সম্মানী। একজন লেখক তার পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করার জন্য প্রকাশকের সহায়তা নেবেন, বইটি প্রকাশ করার পর তার বিক্রয়, বিতরণ সম্মানী, পুনঃ প্রকাশের বিষয়ে কোন শর্তাবলি অনুসরণ করা হবে তার লিখিত চুক্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলা একাডেমির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এবার মেলায় মোট বই বিক্রির পরিমাণ কমপক্ষে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা হলে লেখক সম্মানী শতকরা ৭% ভাগ হলেও মোট সম্মানীর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সম্মানিত লেখকগণ এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। এখানেও বাংলা একাডেমির একটা জরিপ থাকতে পারত।
কপিরাইট আইনের ১৮ ধারায় কপিরাইটের স্বত্ব নিয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কোনো বিদ্যমান কর্মের কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী বা ভবিষ্যৎ কর্মের কপিরাইটের সম্ভাব্য স্বত্বাধিকারী যেকোনো ব্যক্তির নিকট কোনো কপিরাইটের সম্পূর্ণ বা আংশিক মেয়াদের জন্য স্বত্ব নিয়োগ করতে পারেন। তবে শর্ত থাকে যে, ভবিষ্যৎ কর্মের কপিরাইটের স্বত্ব নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্মটি অস্তিত্বশীল হওয়ার পর স্বত্ব নিয়োগ কার্যকর হবে। কপিরাইট অনুযায়ী লেখক প্রকাশকের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হতে হবে এ স্বত্ব অর্জনে। অর্থাৎ লেখকের পাণ্ডুলিপিকে বই হিসেবে প্রকাশ ও বিক্রয়ের যে অধিকার প্রকাশককে দেয়া হয় তার বিনিময়ে প্রকাশক লেখক সমঝোতা সাপেক্ষে একটা সম্মানী প্রদান করা হয়। এই সম্মানী প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে জটিলতা, সে ব্যাপারে অধিকাংশ ভুক্তভোগী লেখকই অবহিত। অনিশ্চিত জীবিকার কারণে জীবনানন্দ দাসের আর্থিক অসচ্ছলতার কথাও আমাদের অজানা নয়।
প্রতিটি দেশেই কপিরাইট আইন রয়েছে। আমাদের দেশেও রয়েছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে না হওয়ায় লেখক যেমন তাঁর সম্মানী বঞ্চিত হন, পাইরেটরা লাগামহীনভাবে চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রকাশকগণ। আর অতি মূল্যায়িত মানহীন বই নিয়ে পাঠক ফেরেন মেলা থেকে। বইমেলায় টাস্কফোর্সের বিচরণ কখনো-সখনো পরিলক্ষিত হয়- এ যেন শুধুই রুটিন দায়িত্ব! বাংলা একাডেমির বিবেচনায় মানহীন বইয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা যদি প্রকাশকগণ কর্তৃক অনুসরণ নিশ্চিত করা হতো তাহলে সদ্য সমাপ্ত বই মেলায় মানহীন বইয়ের সংখ্যা এত বিশাল নাও হতে পারত।
লেখক: জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক
মন্তব্য