আশঙ্কাজনক হারে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। অকেজো হয়ে পড়ছে অগভীর নলকূপ ও সেচ পাম্প। ছড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ততা। সাম্প্রতিক জরিপ মতে, রাজধানীতে প্রতি বছর ১০ ফুট করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ২১ মার্চ ‘বিশ্ব পানি দিবস’ উপলক্ষে ‘দৈনিক ভোরের আকাশ’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য-উপাত্ত ওঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাভাবিক মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি। সেচকাজের প্রায় ৮০ শতাংশই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া খাবার পানির ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে দেশের ভূগর্ভের পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানি অস্বাভাবিক মাত্রায় উত্তোলনের কারণে শুষ্ক মৌসুমে স্বাভাবিক গভীরতার অধিকাংশ নলকূপে পানি উঠছে না। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে দেশের অভ্যন্তরে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়মিত জরিপে দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আর স্বাভাবিক উচ্চতায় ওঠে আসছে না। অস্বাভাবিকভাবে ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ পড়ায় দিন দিন এ সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পানির স্তর প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নেমে যাচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণ নিচে নেমে যাচ্ছে সে পরিমাণ রিচার্জ হচ্ছে না। এছাড়া সেচ কাজে ব্যবহৃত শ্যালো পাম্পগুলো ৭ থেকে ১৫ ফুট গভীর খাদ তৈরি করে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজ ও কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে ৮০ শতাংশ সেচের উৎস ছিল নদ-নদী, বর্তমান কমে গিয়ে ২০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ স্তরের পানির ওপর অধিক চাপ বাড়ছে।
দেশের অন্যান্য এলাকার মতো রাজধানী ঢাকাতেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভীতিকর গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর পানি চাহিদা পূরণে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরতা ৮৬ ভাগ। ওয়াসা বলছে, বর্তমানে এই চাহিদা মেটাতে বসানো হয়েছে ৯০০টি গভীর পাম্প। অথচ ১৯৭০ সালে ঢাকা শহরের পানির চাহিদা মেটাতে পাম্প ছিল মোট ৪৯টি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি অধিক উত্তোলনের ফলে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
ভূগর্ভস্থ অঞ্চলের পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার সঙ্গে ভারতের পানি প্রত্যাহারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) পক্ষ থেকে যে গ্রাউন্ড ওয়াটার মডেলিং করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, উত্তর-পশ্চিমের যৌথ নদী অববাহিকাজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দ্রুতগতিতে নেমে আসছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের পক্ষ থেকেও প্রস্তুত করা গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপে দেখানো হয়েছে, দেশের মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিস্তৃত ৩১টি জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নেমে যাচ্ছে।
বর্ষা মৌসুমে পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ঘাটতির অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি আমরা। বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণে সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ সংকটে পতিত হব আমরা। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে ভাবতে হবে, গ্রহণ করতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা।
মন্তব্য