নদীমাতৃক আমাদের এই দেশ। নগরকেন্দ্রিক জীবনে নদী-খাল একের পর এক উধাও হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্রভাবে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের জলাধার। তাই এই জনপদে অনেক বাড়ির আশপাশে পুকুর কিংবা ডোবা থাকা খুবই স্বাভাবিক। আর খাল-বিল তো রয়েছেই। তাই তো পা বাড়ালেই কোনো জলাধার খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না আমাদের। উপরন্তু এমন কোনো বছর নেই যে বছর বন্যা আঘাত হানে না বাংলাদেশে। আর বন্যার পানিও নিচু এলাকায় জমে থাকে কয়েক সপ্তাহ, কখনো-বা মাসব্যাপী। পানির এই সহজ লভ্যতার কারণেই সাঁতার না জানা শত শত শিশু প্রতি বছর পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। সবসময় সাঁতার না জানার কারণেই ব্যাপারটি ঘটে তা নয়, কখনো শিশুদের ঠিক দেখে না রাখার কারণে, কখনো আশপাশের জলা ডোবা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না রাখার কারণেও ডুবে মরার নজির রয়েছে। আরো মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে, গ্রামীণ অঞ্চলে এই ধরনের ডুবে মরা মৃত্যুকে অনেকেই কুসংস্কার হিসেবে দেখে, তারা মনে করে এই মৃত্যু অনিবার্য।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে সাঁতার না জানায় পুকুরের পানিতে ডুবে মিলন (২২) ও শিমুল (১৫) নামে মামা-ভাগ্নের মৃত্যু হয়েছে। দুপুরে দুজন একসঙ্গে ওই এলাকার ডোবাকৃতির ছোট্ট একটি পুকুরে গোসল করতে নামায় এ ঘটনাটি ঘটে। জানা গেছে, মিলন সম্পর্কে শিমুলের মামা হন। তিনি রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে ডুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। শিমুল বাজিতপুর হাফেজ আবদুর রাজ্জাক হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। ফেনীর দাগনভূঞায় ৪ বছরের জমজ ভাইবোনের অভিভাবকদের অসতর্কতার কারণে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও শেরপুরের নকলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, বরিশালের বাকেরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও চট্টগ্রামের রাউজানে গত ৪ দিনে মোট ৮-৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সাঁতার জানলে এ মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। কেননা তাতে নদীনালা, জলাভূমি সম্পর্কে অনেক ধরনের সতর্কতা তৈরি হয়; এবং মানসিকভাবে কুসংস্কারচ্ছন্ন ও অনিবার্যতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ তৈরি হয়।
উল্লেখ্য, সিআইআরবি ৪ লাখ মানুষের পরিবারে জরিপ চালিয়ে ডুবে যাওয়া মৃত্যুগুলোকে আরো সুনির্দিষ্ট করেছিল কয়েক বছর আগেই। সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল কোথায় কোথায় আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। জরিপ কাজটি স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রণালয় এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সার্ভিসের সহায়তায় চালানো হয়েছিল। এটা ছিল বরিশালের সাউথ সেন্ট্রাল বাংলাদেশের কীর্তন খোলা অঞ্চলভিত্তিক। কেননা ১ থেকে ৪ বছরের শিশুদের ডুবে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করলেও বাংলাদেশের একটি সামগ্রিক সমস্যা।
আমার নিজস্ব একটি অভিজ্ঞতাও রয়েছে। ঘটনাটি ’৯০ এর দিকে। আমার অবস্থান করা কক্ষ থেকে ২০ মিটারের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটেছিল। কেননা আমার পড়ার ঘরের পাশেই একটা পুকুর ছিল, সেখানে ৪-৫ বছরের একটা শিশু হঠাৎ করেই পরিবারের অগোচরে সিঁড়ি দিয়ে পানিতে নামতে গিয়ে জলে পড়ে যায় আর উঠে আসতে পারে না। অথচ আমি তখন পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলাম, জানতেই পারিনি একটা শিশু আমার থেকে সামান্য দূরে পানিতে পড়ে মারা যাচ্ছে। এ মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নেওয়ার নয়।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমিও গত বছর বলেছে, বাংলাদেশে ১-৯ বছরের শিশুদের মারা যাওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি পানিতে ডুবে মৃত্যু। এ মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে সাধারণত বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে জলাধারে। গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে মৃত্যুর এ হার শহরের চেয়ে বেশি, যার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে সেখানে পুকুর আর ডোবার মতো ছোট ছোট জলাধারের সংখ্যা বেশি। এগুলোই বলে, বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সাঁতার শেখাটা খুবই প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাঁতার না জানার কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪৮ ছেলেমেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে বলে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। সে হিসাবে প্রতি বছর ১৮ বছরের নিচে মারা যায় ১৮ হাজারের বেশি ছেলেমেয়ে। ২০০৫ সাল থেকে এই হিসাবটা করা হয়েছে। এটাই বিশ্বে সর্বোচ্চ। তবে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (CIPRB)) মতো অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানই বলছে, সঠিক পদক্ষেপই এ মৃত্যুকে কমিয়ে আনা যেতে পারে।
বছর কয়েক আগে চীনের অন্যতম নামি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদনকারী ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়েছে, স্নাতক ডিগ্রি পেতে হলে তাদেরকে অবশ্যই আগে সাঁতার শিখতে হবে। উল্লেখ্য, শিং হুয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় প্রাচ্যের হার্ভার্ড। তাদের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রির সঙ্গে সাঁতার শেখাকে এভাবে যুক্ত করার সিদ্ধান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলেছেন, যে দেশ এখন খরা মোকাবিলা করছে, নদী বা সাগর নেই, সেখানে এ পদক্ষেপের যৌক্তিকতা কী? সে ক্ষেত্রে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশে এ রকম পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশই নেই। তার ওপর সাঁতার একটি জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা, শরীর চর্চার অংশ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। স্কুল যদি পুরো জীবনকে এমনভাবে গড়ে দেওয়ার অংশ হয়ে থাকে, যাতে সে সমাজের সঙ্গে সুস্থতা বজায় রেখে চলতে পারে, তাহলে শিক্ষায় মনের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শরীরের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জোর দেওয়া আবশ্যিক। সাঁতার শেখার ব্যাপারে আমাদের দেশে বর্তমানে যেসব প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে তার মধ্যে কাছে-ধারে জলাশয় বা পুকুর না থাকা। আর তৃতীয়ত, পড়ালেখার চাপে সাঁতার শেখার সময় নেই।
বাংলাদেশ সরকার এ ক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার। বছর কয়েক বছর (২০১৬) আগে থেকে ডুবে মরে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক পরিপত্রের মাধ্যমে সরকার দেশের সব স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের জন্য সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করতে বলেছে। অবশ্য তা কার্যকর হচ্ছে কি-না সে ব্যাপারে কোনো নজরদারি নেই, নেই কোনো কার্যক্রম। বর্তমানে সাঁতার শেখার ব্যাপারে নানা প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে। প্রথমত, যারা শহরে বসবাস করেন তাদের পক্ষে সন্তানদের সাঁতার শেখানোর মতো কোনো সুযোগ নেই। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরে যেখানে প্রায় চার হাজার পুকুর-দীঘি ছিল, সেখানে এখন শ’ খানেকে নেমে এসেছে। ঢাকায় তা আরো কম। প্রয়োজনীয় সুইমিংপুল না থাকা এবং যা আছে তাতে খরচের কথা বিবেচনা করে সবার পক্ষে সাঁতার শেখানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলেও আজ দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে পুকুর-দীঘির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রত্যেক স্কুলে সাঁতারের ব্যাপারে সরকারের এ রকম পরিকল্পনা জোড়দার করা হলে চারপাশের হাজামজা পুকুরগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। এতে পরিবেশও সজিব হয়ে উঠবে। হাতিরঝিল, রমনা লেক, ধানমন্ডির মতো লেকগুলো আরো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
প্রায়ই আমরা শুনি, এক দল শিক্ষিত ছেলেমেয়ে সমুদ্রে গেল। শুধু সাঁতার না জানার কারণে দু’জনকে মৃত্যুর হাতে রেখে এসে কিছুদিন দুঃখতাপ করল সহপাঠীরা। এটা মেনে নেওয়া খুবই বেদনাদায়ক। শুধু সাঁতার না জানার কারণেই যদি ৪৩ শতাংশ শিশু মৃত্যুবরণ করে থাকে, বিষয়টি আসলেই উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও একটি ভূমিকা পালন করতে পারে।
অতএব, সাঁতার শেখাটা যদি জীবন রক্ষাকারী হয়ে থাকে এবং শিক্ষার অংশ হিসেবে পরিণত করা যায়, তাহলে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের আওতায় একটা জলাধার থাকতে হবে অথবা কৃত্রিমভাবে সুইমিং পুলের ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের পরিকল্পনায় জলাধার বা পুকুরের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা পরিবেশবান্ধব হবে, খেলার জায়গার পরিমাণও বাড়বে। ফলে বিপুলসংখ্যক সম্ভাবনাময় জীবন ক্ষয় থেকে আমরা বেঁচে যাব।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা এবং সম্পাদক, মহাবৃত্ত
মন্তব্য