বাংলাদেশের উন্নয়ন আসলেই বিস্ময়কর। একেবারে শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে এক ডলারও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না। অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত। খাবারের তীব্র সংকট।
কোটি খানিক মানুষকে পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তাঁকে এগোতে হচ্ছিল। মাত্র আট বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। মাথাপিছু জিডিপি তিরানব্বই ডলার। সঞ্চয় জিডিপির তিন শতাংশ। দারিদ্র্যের হার আশি শতাংশ। জীবনের গড় আয়ু সাতচল্লিশ বছর। ক্ষুধা তীব্র। এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেন সোনার বাংলা গড়ার। তিনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার মতোই গুরুত্ব দেন। তাঁর মতে, ‘আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। কি স্বাধীনতা? রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুখী মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পড়তে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে মানুষের মনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।’ (১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে সংগৃহীত)
অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শুরুতেই বেশকিছু মৌলিক নীতি গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। সেগুলো হলো:
এক. কৃৃষির আধুনিকায়ন ও সংস্কার করে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক উন্নতি সাধন করা। উৎপাদনশীল অংশগ্রহণমূলক সমবায় কর্মসূচি গ্রহণ করা।
দুই. সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে তার জাতীয়করণ। শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে উপযুক্ত দেশপ্রেমিক এবং কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর জনশক্তি নির্মাণে বিশেষ নীতি, সহায়তা ও সম্পদ প্রদান।
তিন. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ওপর জোর দেয়া।
চার. শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণসহ দেশজ শিল্পায়নকে জোর দিয়ে পরিকল্পিত শিল্পনীতি গ্রহণ।
এছাড়াও তিনি দ্রুত সব ধরনের অবকাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পুনঃনির্মাণ ও নির্মাণে ব্র্রতী হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এমন বিচক্ষণ নীতি কৌশলের জোরেই দ্রুত বাংলাদেশের অর্থনীতি তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে শুরু করে।
মাত্র চার বছরেরও কম সময়ে বহু বিশেষজ্ঞের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’তে তুলে দিয়েছিলেন। ওই অল্প সময়েই তিনি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তিই শুধু দিয়েছিলেন তাই নয়, বরং দ্রুতগতির এবং জনগণকেন্দ্রিক উন্নয়নের আগামীর পথনকশা জনগণের সামনে হাজির করে তিনি সবাইকে আশাবাদীও করে তুলেছিলেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকেরা বাংলাদেশের এই গতিময় অগ্রযাত্রাকে পঁচাত্তরের আগস্টের পর থমকে দেয়। বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে তাঁর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর ছিয়াত্তরেই মাথাপিছু আয় ১৩৮ ডলারে নেমে যায়। তার পরের বছর তা আরো নেমে হয় ১২৮ ডলার।
বলিষ্ঠ নেতৃত্ব যে কতটা জরুরি তার প্রমাণ মেলে এই মাথাপিছু আয়ের গতিপ্রকৃতিতে। দীর্ঘ তেরো বছর লেগেছিল বাংলাদেশকে পঁচাত্তরের সমপর্যায়ের মাথাপিছু আয়কে টেনে তুলতে। এরপরের কাহিনি আমাদের জানা। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে ফের বাংলাদেশ ফিরেছে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি।
মেগা-অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি ও অ-কৃষি খাতের যুগল উন্নতির ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধি, রিজার্ভ আর রপ্তানির পরিমাণ, মাথাপিছু আয়ের মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকে যেমন, তেমনি ক্ষুধা সূচক, মানুষের গড় আয়ু, জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্সের মতো সামাজিক সূচকগুলোতেও বাংলাদেশের পাঁচ দশকের সাফল্য এবং বিশেষ করে গত বারো-তেরো বছরের অর্জন এখন সহজেই বোঝা যায়।
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ তার খাদ্য উৎপাদন প্রায় চারগুণ বাড়িয়েছে। অর্থনীতির আকার বাড়িয়েছে বায়ান্ন গুণ। রপ্তানি, প্রবাসী আয় এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ঘটিয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। আর আর্থিক ও বিদ্যুৎ খাতের প্রসার তো অভাবনীয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও আর্থিক সেবা পৌঁছে গেছে। আর এসবের প্রভাব সামাজিক উন্নতিতেও পড়েছে। এসবের পাশাপাশি, গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে সেটিও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একই সঙ্গে বেগবান করেছে এবং এর ঝুঁকি সহনক্ষমতা বাড়িয়েছে। বিশেষ করে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে থাকা প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী নাগরিকদের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্ভাবনী নীতি-উদ্যোগগুলো আশাতীত সুফল দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ব্যাংক হিসাবধারীদের এক-তৃতীয়াংশই এখন ডিজিটাল লেনদেন করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য গড়ে এ অনুপাত মাত্র ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অর্জন ও সম্ভাবনাগুলোকে বিবেচনায় নিয়েই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশের এমন সাফল্যের তিনটি প্রধানতম কারণ চিহ্নিত করেছেন।
প্রথমত, তাঁর মতে- বাংলাদেশের সরকার জাতীয় অগ্রযাত্রায় দেশের অ-সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে (অর্থাৎ এনজিওগুলোকে) কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে, ফলে সামাজিক পরিবর্তনে তারা সরকারের পরিপূরক ভূমিকা রাখতে পেরেছে কার্যকরভাবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত এক দশকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে সেটিও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বিশেষত অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি মনে করেন। তৃতীয়ত, কৌশিক বসু মনে করেন যে, বাংলাদেশের তুলনামূলক তরুণ জনশক্তি এবং সস্তা শ্রমের সহজলভ্যতা দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির প্রধানতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সুফল সামাজিক পিরামিডের একেবারে পাটাতনে থাকা, সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য। নীতি-নির্ধারকরা এদিকটিতে মনোনিবেশ করেছেন বলেই অতি-ধনীদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে আয় বৈষম্য কিছুটা বাড়লেও ভোগ বৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে। ফলে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্য হার ছিল ৩৪ শতাংশ।
দুই দশকের মধ্যে দারিদ্র্য হার অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে ২০ শতাংশের আশপাশে এবং অতিদারিদ্র্য হার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমিয়ে ১০ শতাংশের আশপাশে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে মহামারিজনিত অচলাবস্থার ফলে এ দুটি হার ইতোমধ্যে বেড়েছে। তবুও মহামারির আগে এ হারগুলো কমিয়ে আনার কৃতিত্ব সুবিচেনাপ্রসূত সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকেই দিতে হবে। এবং এর জোরেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হ্র্রাসে আগের ধারাবাহিকতায় ফেরা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন নীতি নির্ধারক মহল। সমকালীন ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা কতটা দীর্ঘায়িত হয় তার ওপর এই আশাবাদের বাস্তবায়ন বহুলাংশে নির্ভরশীল। তবে পদ্মা সেতু, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা-অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করা গেলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিকাশ আরো গতিময় হবে।
সব মিলে বাংলাদেশ এক বিস্ময়কর অগ্রগতির রোল মডেলে পরিণত রয়েছে। এখনো সুশাসনের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দুর্নীতি ও বৈষম্য বেশ প্রকট। তবুও গতিময় বাংলাদেশকে স্যালুট জানাতেই হয় তার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে।
“বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে যথার্থই বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।’ যে যেখানেই থাকি না কেন আসুন বঙ্গবন্ধুর সেই দৃঢ় প্রত্যয়কে সুরক্ষা দিই। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।”
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
মন্তব্য