-->
প্রজন্মের চোখে স্বাধীনতা

স্বাধীনতার একান্নে

উম্মে সালমা শাম্মি
উম্মে সালমা শাম্মি
স্বাধীনতার একান্নে
দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন থেকে শুরু করে দেশ আজ ধীরে ধীরে মধ্যম আয়ের একটি দেশে উপনীত হতে চলেছে

‘স্বাধীনতা’ শব্দটি বলতে গেলেই অবচেতনভাবে আমার মানসপটে বেশকিছু চিত্রকল্প ভেসে ওঠে। যেমন- গোধূলি বেলায় রক্তিম আকাশে একঝাক পাখির ডানা মেলে উড়ে চলা, কখনো-বা নদীর প্রবহমান ধারার অনবরত বয়ে চলা কিংবা বাধাহীনভাবে পাড়ে এসে ছিটকে পড়া একেকটি সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন। স্বাধীনতা প্রত্যয়টির মাঝেই কোথায় যেন বাধাহীন ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে। স্বাধীনতা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের এই আলোচনা না হয় আজ বাদই থাক। স্বাধীনতার এই একান্নে এসে আমরা না-হয় আজ অন্য এক স্বাধীনতার আলোচনা করি।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রসত্তা গুনে গুনে তার স্বাধীনতার ৫১তম বছরে এসে পা দিয়েছে। সে হিসাবে আমাদের স্বাধীনতা মধ্যবয়স ডিঙিয়ে পৌঢ়ত্বে পদার্পণ করেছে বলা যায়। ৫১টি বছর তো আর কম নয়। স্বাধীনতার এই পৌঢ়ত্বে এসে আশা ছিল অনেক কিছুই প্রাপ্তির, অর্জনের কিংবা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো কিছু কৃতিত্বের। আহামরি অনেক কিছুর প্রাপ্তি ঘটে গেছে তা যেমন বলব না; আবার একেবারে যে হতাশার অতল তলে নিমজ্জিত হওয়ার মতো কিছু হয়েছে তা-ও নয়। নিজেকে এ দেশের একজন শিক্ষিত, সচেতন ও তরুণ যুবসমাজের অংশ বিবেচনায় আমার দৃষ্টিতে স্বাধীনতার এই একান্নে কিছু অপ্রাপ্তি, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার কথা আলোচনা করতেই পারি।

প্রাপ্তির জায়গায় দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন থেকে শুরু করে দেশ আজ ধীরে ধীরে মধ্যম আয়ের একটি দেশে উপনীত হতে চলেছে। ১৯৭১ সালে যেখানে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ, সেটা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৬৮ শতাংশে। ১৯৭১ সালে যেখানে গড় মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১৩৪ মার্কিন ডলার; সেখানে ২০২২ এসে মানুষের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৫৫৪ মার্কিন ডলার। এরই মধ্যে আমাদের দেশের একজন অর্থনীতিবিদ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। শুধু তাই নয়, আমরা জাতির জনকের নামে মহাকাশে একটি স্যাটেলাইট প্রেরণ করতেও সক্ষম হয়েছি। সর্বশেষ বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায় বহু দেশের তুলনায় অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছি। বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে করোনাবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি, করোনাবিষয়ক গবেষণা, করোনার টিকা আবিষ্কারবিষয়ক গবেষণা এবং টিকাপ্রাপ্তির দিক থেকেও আমরা এগিয়ে আছি। এই যে এতসব কিছুর প্রাপ্তি আসলে আশার উদ্রেককারী ও প্রশান্তিদায়ক বটে।

 

একজন চিন্তাশীল সমাজকর্মের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার হতাশার জায়গাও নিছক কম নয়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে আমরা আজ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর দ্বারপ্রান্তে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় যে গুণগত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, আমাদের শিক্ষার মানকে কি আমরা সে পর্যায়ে উন্নীত করতে পেরেছি? নাকি আমরা বহিঃবিশ্ব থেকে পঠন-পাঠনের কিছু নিয়ম-নীতিকে ধার করে এনে আমাদের পঠন-পাঠনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি। আমরা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে আরো বেশি উপভোগ্য কওে তুলতে পেরেছি। এসব প্রশ্নের জবাবে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি বলব- না, আমরা পারিনি। আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যার ফলস্বরূপ আমরা প্রতি বছর একগাদা ‘আই এম জিপিএ ফাইভ’ জন্ম দিচ্ছি।

আমরা বড় বড় মেগা প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছি, আর এসব প্রজেক্টে পুকুর চুরি ও দুর্নীতির যে চিত্র, বাস্তব অর্থেই এর চেয়ে হতাশার আর কিছু হতে পারে বলে মনে করি না। দুর্নীতিতে প্রথম হতে হতে আমরা এখন ক্লান্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা ও অর্থনীতিতে সামনের কাতারে থাকা শ্রীলংকান অর্থনীতির দেউলিয়াত্বের ব্যাপারে আমরা সবাই কম-বেশি অবগত। দুর্নীতির এই করালগ্রাস একদিন না আমাদের শ্রীলংকার পথে হাঁটায়! বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও ইকো সামাজিক পৃথিবীর গঠন। ২০১৯ সালে একবার জাপান যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, একটি দেশ কিভাবে এত পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিত হতে পারে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো একটি বিষয়ও কিভাবে এত উন্নত হতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় গৃহীতব্য আগাম প্রস্তুতিসমূহ কিভাবে এত দূরদর্শী হতে পারে! ঠিক তখনই আমার দেশের চিত্র মাথায় এলো। সম্প্রতি তো আমরা বায়ুদূষণেও প্রথম হয়েছি। সুস্থ রাজনীতির চর্চা গণতান্ত্রিক দেশে বাঞ্ছনীয়।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছে। অপরাধপ্রবণতা ও আত্মহত্যার সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, এতে করে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা করা খুব বেশি কঠিন কিছু হবে বোধ করি না। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, নরীর কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বেড়েছে ঠিকই; কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা কি কমেছে? এটি প্রশ্নবিদ্ধ।

স্বাধীনতার একান্নে আমরা চাই- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; যা আমাদের যৌক্তিক বলে মনে হবে তা সমস্বরে বলার স্বাধীনতা। আর সেই সুযোগ করে দিতে পারে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার মধ্যে এক্যৈ বিশ্বাসী নীতিনির্ধারকরা। সহিংস মনোভাব, কারো মেধা-মননকে দমিয়ে রাখা কখনো একটি দেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসে না। আমাদের দেশের শিক্ষিত ও মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও বৃহত্তর এক অংশ যারা কিনা দেশের বাইরে অবস্থান করতে আগ্রহ পোষণ করেন তার মূল কারণও কিন্তু এই।

স্বাধীনতার একান্নে সর্বোপরি আমরা চাই- হাজারো বৈচিত্র্যের মধ্যে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে একটি ইকো সামাজিক পৃথিবীর অঙ্গীকার, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন; যা কিনা জ্ঞানী ও প্রকৃত মানুষ তৈরি করবে, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির সুস্থ চর্চা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণ।

আর এভাবেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করতে পারব বলে আশা রাখি। সর্বোপরি, সবাইকে মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, সাকুরা সায়েন্স ক্লাব, জাপান

মন্তব্য

Beta version