রবিনসন ক্রুশো। প্রখ্যাত উপন্যাস। ইংরেজ সাহিত্যিক ড্যানিয়েল ডিফোর অনবদ্য এক রচনা। প্রকাশিত হয়েছিল ১৭১৯ সালে। সেখানে আমরা দেখতে পাই, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, যার নামেই উপন্যাসটির নাম, সেই রবিন তার তোতাপাখিকে ভাষা শেখায়। একদিন রবিন কিছুটা দূরে এক বেড়ার পাশে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়েন। এমন সময় কেউ একজন তার নাম ধরে ডাকতে থাকে। ততক্ষণ, যতক্ষণ না ঘুম ভাঙে রবিনের। এবং রবিন আবিষ্কার করল, ‘হতচ্ছাড়া রবিন’ বলে করুণ সুরে তাকে ডাকছে। সে আর কেউ নয় বরং পল, রবিনেরই পোষা পাখি।বিস্মিত হয়েছিল স্বয়ং রবিন। যেভাবে পাখিটাকে ডাকত সে, একইভাবে পল তাকে জাগিয়েছে। রবিন বা মানুষ কেন পাখিকে ভাষা শেখাতে চায়? কারণ, মানুষ নিঃসঙ্গ থাকতে চায় না। সঙ্গী জুটাতে চায়। যোগাযোগের এই আকাঙ্ক্ষা মানুষের শুধু পৃথিবীর গতিতে সীমাবদ্ধ নয়। এই পৃথিবীতে সাতশ কোটি মানুষ। তবু মানুষ নিঃসঙ্গ, অন্তত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অসীমতায় নিজেকে নিঃসঙ্গ বলেই মনে হয় মানুষের। সে এক নিঃসঙ্গ মহাজাগতিক পথিক। কিন্তু মানুষ এই নিঃসঙ্গতা ঘুঁচাতে চায়!
সভ্যতা- প্রাচীন এক প্রশ্ন মানুষকে ভাবিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পৃথিবীর মতো কি কোনো বাসস্থান নেই মহাবিশ্বে? রাতের আকাশে যত তারা তার চোখে ধরে, ওগুলোর কোথাও কি মানুষের মতো (কিংবা ভিনরূপী) কোনো জীব নেই? এই প্রশ্নের উত্তর সে জানে না। কিন্তু তার অনুমান, কখনো দৃঢ় বিশ্বাস আলো-আঁধারিতে কোথাও না কোথাও ‘ভিনগ্রহবাসী’ আছে। ড্রেক সমীকরণের মাধ্যমে বের হওয়া হিসেবও তাই বলে। মানুষ তাই চায়, যে করেই হোক সেই ‘মহাজাগতিক সঙ্গী’র সঙ্গে তার যুক্তি আর অনুভবের বিনিময় চাই। আর এজন্যই মানুষ যোগাযোগের জাল ছড়িয়েছে মহাশূন্যে। শুধু সৌরজগতের সীমারেখা নয়, আকাশের সীমাহীনতাকেও মাড়ানোর স্বপ্নে বিভোর মানুষ। কিন্তু এমন মহাজাগতিক যোগাযোগের বেলাতেও তো দরকার পড়বে সাধারণ একটা ব্যবস্থা। বিশেষত, একই ভাষা। যেমনটা রবিন আর তার তোতাপাখির মধ্যে দেখা গেছে।
না, মানুষ পাখির ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছে হয়তো, কিছুটা পাঠোদ্ধার যে সে করতে পারেনি তাও নয়। কিন্তু পাখির সঙ্গে পাখির ভাষায় কথা সে বলতে পারেনি। মানুষ তাই পাখিকেই শিখিয়েছে নিজের ভাষা। যেন সেই ভাষায় পাখি ডাকলে সে সাড়া দিতে পারে। জনবহুল এই পৃথিবীতে মানুষ যে ক’টা ভাষা জানে, তারই একটা-দু’টা ভাষাতেই মানুষ ভিনগ্রহের সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। কী সেই ভাষা?ভাষা গড়ে ওঠে একটা স্থানের নিজস্ব পরিবেশে- জল, বায়ু, কাদা, মাটি মিশে থাকে একটি আঞ্চলিক ভাষায়। এর ভেতর থাকে না ব্যাকরণের বিধিনিষেধ। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে আপন আপন স্বতন্ত্র ভাষা। যে ভাষার মধ্য দিয়ে একই গোত্রভুক্ত মানুষ আপন ভুবনে যোগাযোগ সাধন করে।
কিন্তু দুটো গোত্রের মানুষ কীভাবে যোগাযোগ স্থাপন করবে? তখনই দরকার পড়ে এক ধরনের মধ্যপন্থার, ভাষার ওপর ভর করে ব্যাকরণ-বিধি। কিছুটা স্বাধীন, কিছুটা ছকে বাঁধা। স্বতন্ত্র ভাষা যেন একটা ছাঁচের মধ্যে আসতে বাধ্য হয়। আঞ্চলিক ভাষার চেয়ে এতে পরিশীলিত ভাব বেশি থাকে। যোগাযোগের প্রয়োজনেই এটা মানুষকে করতে হয়েছে। এভাবে গড়ে ওঠে প্রমিত বা স্ট্যান্ডার্ড ভাষা। এই ভাষায় বিধি যোগ হয় ঠিকই, স্বকীয়তা কম থাকে, কিন্তু অনেক আঞ্চলিক ভাষার যোগসাজশে সমৃদ্ধি ঘটে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। দুটি ভিন্ন গোত্র বা অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এনে দেয় নৈকট্য। এই সমৃদ্ধি যত বিকশিত হবে, বৈচিত্র্য তত বাড়বে যদি আঞ্চলিক ধারাগুলোর স্বাভাবিক গতিকে বিঘিœত না করি। এ রকম একটি ভাষা বাংলা।
সূর্য ছাড়িয়ে দূরশূন্যে ছুটছে বাংলা ভাষা। বেশ কিছুদিন আগে ২০১৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন আসে। সত্যি বাংলা ভাষা ছুটে চলেছে মহাজাগতিক অন্বেষণে ভয়েজার মহাকাশযানে। পৃথিবীর ৬০ দেশের ৫৫টি ভাষার মতো এই ভাষা মহাজাগতিক বাসিন্দাদের জানাচ্ছে সম্ভাষণ: ‘নমস্কার, বিশ্বের শান্তি হোক।’ ভাবতে ভালোই লাগে- যে ভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষেরা প্রাণ দিয়েছিল তা মহাজাগতিক গতি পেয়েছে। যদিও এ ভাষা বিকাশে আমাদের প্রচেষ্টা খুব একটা আন্তরিক নয়। নইলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সঠিকভাবে ব্যবহার করতাম। আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাইনবোর্ডে এ ভাষার ব্যবহারে গুরুত্ব দিতাম। সম্প্রতি বাইরের বিশ্বের বইগুলো আগের চেয়ে বেশি অনুবাদ হচ্ছে, কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। অবশ্য এতে আমরা ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি, কিন্তু আমাদের লেখক গবেষকদের কাজগুলোর অনুবাদ প্রায় না হওয়ার কারণে তারা আমাদের সাংস্কৃতিক অবস্থান সম্পর্কে ঠিকমতো জানছে না, ফলে বুঝতে পারছে না। এটা পরস্পরকে বুঝে একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে রেখেছে বলা যায়।
ভাষা মস্তিষ্কের অনেক বিস্তৃত ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। নিম্ন মস্তিষ্কের সেরেবেলাম থেকে শুরু করে উচ্চ মস্তিষ্কের প্রিফ্র্রন্টাল কর্টেক্সের অনেক এলাকা ভাষার উপলব্ধি, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সাথে জড়িত। এই এলাকাগুলোর বেশকিছু নামের সাথে অনেকেই পরিচিত। যেমন ওয়ারনিকের এলাকা, ব্রোকার এলাকা ইত্যাদি। লিখিত ভাষা উপলব্ধির সাথে চোখ ও মস্তিষ্কের দৃশ্য অঞ্চল জড়িত। অপরদিকে কথ্য ভাষা উপলব্ধির সাথে কান ও মস্তিষ্কের শ্রবণ অঞ্চল জড়িত। ভাষা শেখার আগে মানুষ ইশারায় কথা বলত। আদিম মানুষের টিকে থাকার ক্ষেত্রে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তাই বিবর্তনের ধারায় মানুষের মস্তিষ্কে ভাষা শিখে নেওয়ার জন্য একটি গোছানো নিউর্যাল সার্কিট রয়েছে। এই নিউর্যাল সার্কিটে অভিজ্ঞতার সাথে সাথে উপযুক্ত ভাষাবিষয়ক নিউর্যাল কোডগুলো নির্মিত হতে থাকে। নিউর্যাল কোডগুলো নিউরনগুলোর জেনেটিক কোডের ওপর বেশ নির্ভরশীল। কেননা নিউর্যাল কোড তৈরি হয় জিন সক্রিয়করণ আর নিষ্ক্রিয়করণের মধ্য দিয়ে। আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে, নতুন নিউর্যাল কোড তৈরি হয় পুরনো নিউর্যাল সার্কিটে মডিফিকেশনের মাধ্যমে। তাই এই নিউর্যাল কোড, জেনেটিক কোড, নিউর্যাল সার্কিট এসব বিষয় প্রতিটি ভাষাতে কমন বলে ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি, স্টিভেন পিঙ্কার মন্তব্য করেছেন। তারা এসব বিষয়কে প্রমুখ ভাষা শেখার ক্ষেত্রে ‘সার্বজনীন’ কথাটা বলেছেন।
পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠী মানুষের কাছে সাধারণ ভাষার ভিন্নতা থাকলেও গণিত বা বিজ্ঞানের ভাষার ব্যাপারে কোনো পার্থক্য নেই। প্রাণরাসায়নিকভাবে একই উপাদানের হলেও বিবর্তন প্রক্রিয়া বা বেড়ে ওঠার পরিবেশ ভিন্ন হলে সেক্ষেত্রেও কি এটা সার্বজনীন থাকবে? এটা নিয়ে যথেষ্ট স্পষ্ট ধারণা এখনো আছে বলা যায় না, বিতর্ক আছে যথেষ্টই। তবে বিজ্ঞান ও গণিতের মিলিত শক্তি এক ধরনের ঐক্য তৈরি করবে বলেই মনে হয়। কারণ গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি বা মহাবিশ্বের প্রকৃতির নিয়মগুলো অভিন্নতা এখনো সব পর্যবেক্ষণ সমর্থন করছে।
বর্তমানে পৃথিবী নামের এই গ্রহের মানুষের সঙ্গে সাধারণ যোগাযোগের জন্যও একটা সাধারণ ভাষা বিকাশ লাভ করছে। যা একটি বৈশ্বিক প্রমিত ভাষায় রূপ নেবে, ব্যাকরণের বিধিনিষিধের সাথে নমনীয়তাও বৃদ্ধি পাবে এবং ধীরে ধীরে গাণিতিক যুক্তির প্রভাবও বাড়বে। অন্য কোনো নক্ষত্রের কোনো গ্রহের প্রাণীর সাথে (যদি থেকে থাকে) যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়বে সে রকম একটা সাধারণ ভাষার। আন্তঃনাক্ষত্রিক সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমিয়ে আনতে যে ভাষাটিতে গণিত ও বিজ্ঞানের প্রবল প্রভাব পড়বে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিজ্ঞানীরা বহির্জাগতিকদের সাথে যোগাযোগের জন্য গণিত ও গাণিতিক যুক্তি এবং বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে কয়েকটি ভাষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন। এদের একটি হলো অ্যাস্ট্রগ্লোসা (astraglossa)। ১৯৬৩ সালে ল্যান্সেলট হগব্যান এই ভাষা ব্যবস্থাটি উপস্থাপন করেন। এই ব্যবস্থায় পর্যায়ক্রমিকভাবে সংখ্যা এবং চিহ্নের সারি ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে স্বল্প পর্যায় দিয়ে সংখ্যা আর দীর্ঘ পর্যায় দিয়ে গণিতিক চিহ্ন (যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ) বোঝানো হয়েছে। আরেকটি ভাষা ব্যবস্থার লিঙ্গুয়া কসমিকা (Lingua cosmica)। সংক্ষেপে লিনকস (Lincos)। ১৯৬০ সালে হ্যান্স ফ্র্রডেন্থাল এ ভাষা উদ্ভাবন করেন। এ ভাষা অ্যাস্ট্রগ্লোসার আরেক রূপ। লিনকস তৈরি হয়েছে মহাজাগতিক যোগাযোগ ও আলোচনার জন্য। এতে মৌলিক গণিত আর লজিক সিম্বল ব্যবহার করা হয়েছে। এ ভাষা কার্ল সাগান তার কল্পবিজ্ঞান ‘কন্ট্যাক্ট’ এবং এর উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছেন।
অ্যাস্ট্রগ্লোসা ও লিনকসের উপর ভিত্তি করে ১৯৯২ সালে আরেকটা ভাষা ব্যবস্থা প্রস্তাব করেন কার্ল ডেভিটো ও রিচার্ড অয়ার্ল। তবে এ ব্যবস্থার শব্দগুলোকে সমৃদ্ধ করতে তারা বিজ্ঞানের মূলনীতি এবং পদার্থের ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যবহার করেছেন।
২০১০ সালে মাইকেল ডব্লিউ বাচ আরেকটি ভাষা উপস্থাপন করেন। এটি বাইনারি ব্যবস্থা। লোন সিগনাল প্রকল্পে এটা ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন মাসে ১৭.৬ আলোকবর্ষ দূরে গ্লিস ৫২৬ নক্ষত্রের বহির্জাগতিকদের উদ্দেশে এই বার্তাটি পাঠানো হয়েছে। মূলত এটা ছিল বাইনারি ব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠানো ১৪৪টি বার্তা।
বর্তমানে পৃথিবীবাসীর পক্ষ থেকে ভিনগ্রহী বুদ্ধিমত্তার উদ্দেশে বাংলায় রেকর্ড করা ভয়েজারের গোল্ডেন রেকর্ডে থাকা এ শুভেচ্ছাবার্তা আমাদের সূর্যের সীমানা পেরিয়ে গেছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে (১৯৭৭ সাল থেকে) আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে নিরলস ধাবমান ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২। ভয়েজার অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন প্রয়াত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান। তার তত্ত্বাবধানে কাজ করেছেন মহাজাগতিক চিত্রশিল্পী জন লোমবার্গ ও বিজ্ঞানী জিম বেল। তারা পৃথিবীর ভাষা বৈচিত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে মানুষকে একত্র করতে চেয়েছেন। ভিনগ্রহের কোনো সভ্যতার উদ্দেশ্যে নিজেদের বাঙালি, ইংরেজ, ফরাসি হিসেবে নয় বরং বলতে চেয়েছেন, ‘আমরা পৃথিবীবাসী বা আর্দিয়ান। যারা নিজেদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে বিকশিত হয়ে চলেছি। আমরা তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই’।
এভাবে ভয়েজার লাখ লাখ বছর আন্তঃনাক্ষত্রিক শূন্যে ছুটে চলবে। যদি সত্যি সত্যি বহির্জাগতিক সভ্যতা এই বার্তাটি পায়, বাংলা সম্ভাষণটি শুনে কি বুঝতে পারবে (!) রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বহীনতা ও স্বার্থপরতায় ৪৭-এর দেশ বিভাগে ছিন্নভিন্ন হওয়া বাংলা ভাষাভাষি সমাজটির কথা, ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়া দেশটির কথা। প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও নিজের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষাভাষির মানুষ অব্যাহত চেষ্টায় গড়ে তুলতে চাচ্ছে মহাজাগতিক ঐক্য।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা এবং সম্পাদক, মহাবৃত্ত (বিজ্ঞান জার্নাল)
মন্তব্য