-->
শিরোনাম
দৈনন্দিন

মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুদদারের দৌরাত্ম্য

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব  হোসাইন মাজেদ
মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুদদারের দৌরাত্ম্য
লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ছে দিনকে দিন

মুসলমানদের সর্বাধিক প্রিয় মাস পবিত্র মাহে রমজান সন্নিকটে। বরাবরই পবিত্র রমজান আসার আগেই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবন অসহনীয় করে তোলেন। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকার ও আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। রমজান মাসকে সামনে রেখে যেভাবে প্রতিদিন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে প্রতি বছর হরেক রকমের মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুদদারের আবির্ভাব ঘটে। এসব ব্যবসায়ী চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চাল, সয়াবিন, খেজুর, পাঞ্জাবি, শাড়ি ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করে থাকেন।

একটি কথা প্রচলিত আছে, এসব ব্যবসায়ী বলে থাকেন- ‘রমজানের এক মাস ব্যবসা করব, সারা বছর আরামে কাটাব’। পবিত্র রমজান মাস মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি বিশেষ নিয়ামত। এটি সংযম ও নাজাতের মাস, পাপমুক্তির মাস। অথচ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কারণে এ রহমতের মাসে জনজীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় ও যন্ত্রণাদায়ক। অর্থাৎ, রমজান মাস নাজাতের মাস হলেও আমাদের দেশে তা আতঙ্কের মাসে পরিণত হয়। ইসলাম ধর্মে অতিরিক্ত মূল্য আদায়কে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা যদি সীমাতিরিক্ত মূল্য আদায় করে এ সুযোগে যে, ক্রেতা পণ্যের মূল্য জানে না; তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণের মূল্য সুদ হিসাবে গণ্য হবে।’ আবার মজুদদারি সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মজুদদার অত্যন্ত নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়, তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর দাম বেড়ে গেলে আনন্দিত হয়।’ (মেশকাত)

রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের অমীয় বার্তা নিয়ে হাজির হতে চলেছে মাহে রমজান। কিন্তু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা রমজানের আগেই পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। রমজান মাসে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নানারকম অঙ্গীকার-প্রতিশ্রæতি থাকে। কিন্তু বরাবর দেখা গেছে, কোনো বিশেষ উপলক্ষে বাজারের নাটাই থাকে অশুভ চক্রের হাতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রæতি ব্যবসায়ীরা থোড়াই কেয়ার করে, পণ্যমূল্য ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেয় তারা। ফলে বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়। সে কারণে পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে সব মহল ব্যবসায়ীদের বারবার অনুরোধ করার পরও তাদের সেই প্রতিশ্রæতি কাজে আসে না। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে পুরো দেশের বাজারব্যবস্থা অস্থির হয়ে ওঠে।

আমাদের দেশে মানুষে-মানুষে আয়-ব্যয়ের বিস্তর ফাঁরাক। খাদ্যপণ্য ভোগের ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য লক্ষ্যণীয়। বাজারে থরে থরে সাজানো দ্রব্যের কমতি নেই। তবে লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। এজন্য ভোক্তা আইন-আন্দোলন ইত্যাদি থাকলেও বাজার মনিটরিং করার দায়িত্বে নিয়োজিত কাউকে অকুস্থলে খুঁজে পাওয়া যায় কি?ফেসবুকে এক বন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘সামনে রোজা আসছে। দেখবেন রোজার আগমনে অন্যান্য মুসলিম দুনিয়া শান্ত হয়ে আসছে। মানুষের মাঝে একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে শুরু হবে কেনাকাটার মচ্ছব। যার দুই কেজি পেঁয়াজ দরকার সে কিনবে বিশ কেজি। যার এক কেজি চিনি দরকার সে কিনবে দশ কেজি। এমন করে খাবার মজুদ করা শুরু হবে যেন সারা বছর না খেয়ে ছিল! যেন রোজার পর আর কোনোদিন খাবার খাবে না। দুনিয়ার সব খাবার এই ত্রিশ দিনেই খেয়ে শেষ করতে হবে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পবিত্র রমজানের ব্যানার সাঁটিয়ে ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরাও অপবিত্র কাজ করা শুরু করে দিবে।’

রাস্তার মোড়ে মোড়ে এত এত মসজিদ, মাঠে এত এত ওয়াজ, গলিতে গলিতে এত এত মাজার হওয়ার পরও পরিবর্তন হচ্ছে না কেন এসব প্রবণতা? ধর্মের দোষ দিচ্ছি না, মসজিদেরও না, মাজারেরও না। শুধু আত্মসমালোচনা করছি। মহান আল্লাহ তায়ালা রমজানের প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে আমাদের আরো বেশি সৎ ও বিনয়ী হওয়ার তৌফিক দান করুন। নকল ও ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা রমজানের সময় একটি ভয়ঙ্কর সংকট। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের তারিখ পরিবর্তন করে বিক্রি করার প্রবণতাও বেড়ে যায় এ সময়। লক্ষ করা গেছে, প্রাণঘাতি করোনার ভয়ে মানুষ যখন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাহস হারিয়ে ঘরে বসে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তখন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে কেনাকাটার ফাঁদ পেতে বসেন।

অনলাইনে কেনাকাটার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ও টিভি-পত্রিকা ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ফেলে নিরীহ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। গুদামের পচা খাদ্যশস্য, দোকানের ছেঁড়াফাটা কাপড়, ভেজাল তেল-ঘি, নকল জুস, হোটেল-রেস্তোরাঁর বাসি-পচা খাবার ইত্যাদি এখন অনলাইনে কেনাকাটার পণ্যদ্রব্য। তাই নিরুপায় মানুষকে নিত্য প্রতারিত হতে হচ্ছে অনলাইন কেনাকাটায়। আর গত দুই বছর করোনায় ঘরবন্দি ছিল মানুষ; এখন কার ওপর ভরসা করে, কি খেয়ে জীবন নির্বাহ করবে? নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে টিসিবিকে পাড়ায় পাড়ায় নিত্যপণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে যেন নিত্যপণ্যের অভাবে হাহাকার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে সরবরাহ চেইন নিয়মিত ঠিক রাখতে তৎপর হতে হবে।

আমাদের প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকায় দেশের অধিকাংশ ক্রেতা-ভোক্তা তাদের অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে সহজেই অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। উপরন্তু অধিকাংশ ভোক্তা আসল-নকল চিহ্নিত করে সঠিক পণ্য পছন্দ করতে পারেন না। এতে তারা অনেক সময় বিপাকে পড়ে যান। তাই ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং প্রচার চালাতে হবে- যাতে সাধারণ মানুষ জানতে পারে কিভাবে সঠিক পণ্য কিনতে হবে এবং কোনো অন্যায় দেখলে সেখানে প্রতিবাদ করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত যেকোনো নীতিনির্ধারণীমূলক ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে- যাতে তারা তাদের অধিকারের কথা তুলে ধরতে পারেন। আর কেউ যেন অন্যায়ভাবে অপরের রিজিক কেড়ে না নেয় সেজন্যও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

রমজানের রোজা রেখে মানুষের আত্মশুদ্ধি হোক। আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হয়ে সব পাপ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবার আত্মা জেগে উঠুক। রোজার মহিমায় অতি মুনাফালোভী, মজুদদার ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারীদের ভণ্ডামি নস্যাৎ হোক। শয়তানের প্রভাবে বিচ্যুত সব মানুষ রোজার তাপে পুড়ে আত্মোপলব্ধি থেকে আত্মশুদ্ধি লাভ করে ঈমান মজবুত করুক এবং ফিরে পাওয়ার প্রেরণা পাক দুই জীবনের কল্যাণ।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

মন্তব্য

Beta version