ইউক্রেন সংকটে ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। রুশ সেনারা রাজধানী কিয়েভসহ ছোট-বড় সব শহর ঘিরে ফেলে ইউক্রেন সেনাদের প্রতি অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে। রুশ সেনারা বলছে, ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি এড়াতে ইউক্রেনের সামনে সমঝোতাই সর্বোচ্চ পথ। বিষয়টি ইউক্রেন সরকারও গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইতোমধ্যে শান্তি প্রস্তাব দিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। ন্যাটোতে যোগদানের আশঙ্কা পরিত্যাগের কথাও বলেছেন তিনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি নেই। বিভিন্ন শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে শান্তি আলোচনা। ফলে ইউক্রেন সংকট শুধু ইউক্রেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। একই সঙ্গে ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বকেই গ্রাস করছে।
ইতোমধ্যে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সারা দুনিয়ায়। শুধু জ্বালানি তেল ও খাদ্য পণ্যের মধ্যেই এই মূল্যবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ নেই। এই সংকট পরিবহণসহ বিশ্ব বাণিজ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। প্রভাব ফেলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও। সেই সঙ্গে শেয়ার বাজারে ধস ও মুদ্রাস্ফীতির মতো ঘঁনা তো আছেই। কিন্তু তা সতত্ত্বেও সংকট নিরসনের পরিবর্তে সংকটকে উস্কে দিয়ে একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। এমনকি রাশিয়ার তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ তুরস্ক থেকে নিয়ে ইউক্রেনে মোতায়েনের চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে নানাভাবে ইউক্রেনের সেনাদের মনোবল চাঙ্গা করতে। সেই সঙ্গে ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য ভাড়াটে সৈন্য সংগ্রহ করছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এই যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে জানে খুব ভালোভাবেই। জানে এই যুদ্ধে ইউক্রেন পরাজিত হবে। রুশ অভিযান সফল হবে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে এই তৎপরতা অব্যাহত আছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই যুদ্বের জন্য পরাজয় বড় বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বড় বিষয় হলো- এই যুদ্ধে রাশিয়াকে কতদিন যুক্ত রাখা যায়। এর ফলে ইউক্রেন ধ্বংস হলো কি থাকল বা ইউক্রেনের কত প্রাণহানি হলো, কত মানুষ বাঁচতে দেশ ছাড়ল তাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয় হলো- এই যুদ্ধে রাশিয়া কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আর তাই তো রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করছে বিশ্ব বাণিজ্য থেকে রাশিয়াকে উচ্ছেদ করতে। এটা যুক্তরাষ্টের হঠাৎ কোনো ‘একক চেষ্টা’ নয়। এটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতির দীর্ঘদিনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত।
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে- তাদের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি এমন করে ঢেলে সাজাতে হবে যেন ভবিষ্যতে আর কোনো দেশ কখনো যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে না পারে। ভবিষ্যতে যেন কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দেখা না দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হলে ক্রেমলিন-সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের মাথা ব্যথার কারণ হয়। তাই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংসের চক্রান্ত শুরু করে। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওই চক্রান্ত সফল হয়। এই সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতের চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে- কোনো দেশ যেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে না পারে তার জন্য পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র যা বলে তাই হয়। ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান যুদ্ধ তার বড় প্রমাণ। শুধু আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়া নয় সারা দুনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের এই আধিপত্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়ার। যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হামলা করে সিরিয়া দখল করার চেষ্টা করলে রাশিয়া বাঁধা দেয়। রাশিয়া সিরিয়ার পাশে দাঁড়ায়। কারণ ততদিনে রাশিয়া কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তবে চলমান ইউক্রেন সংকটের শুরুটা অনেক আগেকার। এই সংকটের আরো অনেক কারণ আছে। কারণগুলো হচ্ছে- ১. তথাকথিত অরেঞ্জ রেভুলিউশনের নামে ইউক্রেনের নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করে ইউক্রেনে পশ্চিমা মদদপুষ্ট সরকার গঠন। ২. পশ্চিমা মদদপুষ্ট সরকার গঠনের পর ইউক্রেনের সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় রুশ ভাষাভাষিদের উচ্ছেদ প্রচেষ্টা শুরু হয়। ইউক্রেনের মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশ রুশ ভাষাভাষি। এই বিপুলসংখ্যক রুশ ভাষাভাষিদের স্বীকারের পরিবর্তে ইউক্রেন পার্লামেন্টে একমাত্র ইউক্রেনিনাল ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষিদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ৩. ইউক্রেন সরকারের রুশ ভাষাভাষিদের প্রতি বৈষম্যের ফলে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষি স্বায়ত্বশাসিত ক্রিমিয়া অঞ্চল নিজেদেরকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং গণভোটের মাধ্যমে ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ক্রিমিয়ার জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে স্বাগত জানিয়ে তার দেশের সঙ্গে যুক্ত করে। ক্রিমিয়া রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ইউক্রেন সরকার ভীষণভাবে হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। কিন্তু পরিস্তিতি এমন ছিল যে ইউক্রেন সরকারের করার কিছুই ছিল না।
ক্রিমিয়ার স্বাধীনতা ও রাশিয়ার সঙ্গে য্ক্তু হওয়ার ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে ডনবাস অঞ্চলের রুশ ভাষাভাষি লহানেস্ক ও দানেৎস্ক নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। লুহানেস্ক ও দানেৎস্কের স্বাধীনতা ঘোষণায় ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে সেনা মোতায়েন ও ব্যাপক গ্রেপ্তার নির্যাতন। এই গ্রেপ্তার নির্যাতন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, লুহানস্ক ও দানেৎস্কের জনগণ সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে। সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে নিজস্ব বাহিনী। ইউক্রেন তাদের বিদ্রোহী বাহিনী হিসেবে বর্ণনা করে সেনা অভিযান জোরদার করে। ফলে শুরু হয় ব্যাপক রক্তক্ষয় লড়াই। যে লড়াইয়ে বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ১৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
ইউক্রেনের এই সেনা অভিযান ও লুহানেস্ক-দানেৎস্কের হত্যাযজ্ঞে পাশ্চাত্য বিশ্ব দুঃখ প্রকাশ বা শান্তি প্রচেষ্টার পরিবর্তে ইউক্রেন বাহিনীকে অস্ত্র ও সরঞ্জাম দিয়ে পরিস্থিতিকে উষ্কে দেয়। রুশ জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যাযজ্ঞ নিয়ে রাশিয়া কড়া প্রতিবাদ জানায় এবং এই বিষয়ে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষকে আলাপ-আলোচনার আহ্বান জানায় কিন্তু ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখে। অবশ্য এক পর্যায়ে বহুপক্ষীয় চুক্তি হয় বেলারুশের রাজধানী মিনিস্কে। রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউক্রেনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই চুক্তির ফলে লুহানেস্ক ও দানেৎস্কে যুদ্ধ বিরতি হয়। এবং সব পক্ষ একমত হয় যে, আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান করা হবে। কিন্তু ইউক্রেন এই চুক্তি বাস্তবয়নে দীর্ঘসূত্রতার পথ গ্রহণ করে চুক্তিকে অকার্যকর করার চেষ্টা করে।
৫. এসব ঘটনার মাঝে উত্থান হয় প্রেসিডেন্ট ভেলোদমির জেলেনস্কির। জেলেনস্কি ক্ষমতায় বসেই পশ্চিমাদের সাথে দহরম-মহরম শুরু করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ ও ন্যাটো সদস্যপদের জন্য আবেদন করে। শুরু হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আলোচনা। এই আলাপ-আলোচনার মাঝে গোপনে ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। কোনো ঘোষণা ছাড়াই মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনী ইউক্রেনীয় সেনাদের সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করে। এ বিষয়ে রুশ অভিযোগকে যুক্তরাষ্ট্র বারবার প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু ইউক্রেনে রুশ অভিযানের আগ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তাদের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।৬. ইউক্রেনে শুরু হয় জীবাণু অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নেতৃত্বে একাধিক ল্যাবরেটরি গড়ে ওঠে অত্যন্ত গোপনে। এসব নিয়ে রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বারবার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। অবশ্য ইউক্রেনে রুশ অভিযানের পর সেই ল্যাবের অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছে।
৭. জেলেনস্কির নেতৃত্বে ইউক্রেনে উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে সে দেশে নব্য নাৎসিবাদের উত্থান হয়েছে।ইউক্রেন সংকটের এই ৭টি কারণ ছাড়া আরো বিভিন্ন কারণ রয়েছে, তা হলো রাশিয়ার আর্থিক ও সামরিক উত্থানকে যুক্তরাষ্ট্রের মেনে না নেওয়া এবং রাশিয়াকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে রাশিয়াকে শক্তিহীন দেশে পরিণত করার মার্কিন পরিকল্পনা। ২৪ ফেব্রুয়ারি-২২ এ ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সামরিক মহড়া চলাকালে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক টেলিভিশন ভাষণে ইউক্রেনে সেনা অভিযান ও লহানস্ক এবং দানেৎস্ককে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দেন।প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘোষণার পর শুরু হয় বিশ্ব নেতাদের দৌড়-ঝাঁপ। এই দৌড়-ঝাঁপ ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের জন্য নয়। দৌড় ঝাঁপ শুরু হয় ন্যাটোর ঐক্য ও শক্তি প্রদর্শনের এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধসহ ইতিহাসের নজিরবিহীন নিষেধজ্ঞা আরোপ। সেই সঙ্গে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক কুৎসা ও মিথ্যাচার। ঠিক যেমনটি হতো সোভিয়েত আমলে।
ইউক্রেন সংকটের জন্য আমেরিকার একজন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আমেরিকাকেই দায়ী করেছেন। তিনি হলেন জন মিয়ারশাইমার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইউক্রেন সংকটের জন্য আমেরিকাই দায়ী। ইউক্রেন সংকট বা ইউক্রেন যুদ্ধকে অনেকে ‘দেশ দখলের যুদ্ধ’ বলেও বর্ণনা করছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা দেশ দখলের যুদ্ধ নয়। বিশ্ব একক শক্তির পদাবনত হবে, নাকি ক্ষমতার ভারসাম্যে ক্ষুদ্র সামর্থ্যরে দেশও মাথা উঁচু করে থাকবে তার নিষ্পত্তি করতেই এই লড়াই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
মন্তব্য