-->
শিরোনাম
সচেতনতা

মানব রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক: দায় কার?

উম্মে সালমা শাম্মি
উম্মে সালমা শাম্মি
মানব রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক: দায় কার?
প্লাস্টিক দূষণের ভয়াল থাবা এক এক করে জীবন কেঁড়ে নেওয়ার আগেই আমাদের সচেতন হতে হবে

সম্প্রতি আইকিউ এয়ারের বায়ুমান সূচক প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৪টি। একই সাথে বিশ্বে বায়ু দূষণে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এই তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই দেশের শিক্ষিত-সচেতন জনগোষ্ঠী, পরিবেশ বিশ্লেষক এবং সেই সাথে সাথে সুশীল সমাজকেও বেশ নড়েচড়ে বসেতে দেখা যায়।

এরইমধ্যে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দি গার্ডিয়ান’ একটি প্রতিবেদনে আরো একটি অবাক করা তথ্য প্রকাশ করেছে; সেটি হল- মানুষের রক্তে প্রথমবারের মতো ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ দূষণ শনাক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীরা আরো জানিয়েছেন যে, শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক- এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক! যা প্লাস্টিকের একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং আকারে ২ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার হয়ে থাকে। সাধারণত নিত্যব্যাবহার্য প্লাস্টিকবর্জ্য তাপমাত্রা, অণুজীব ও অন্যান্য কারণে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। যেই মাইক্রোপ্লাস্টিক কি-না রক্তের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে। আর মানব রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের এই উপস্থিতি কিন্তু প্লাস্টিক দূষণেরই ফলাফল। বায়ু দূষণে শীর্ষে অবস্থানই বলুন আর মানব রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিই বলুন- আসলে এর দায়ভার কার! আপনি বা আমি কেউ-ই কি এর দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারি? সোজাসাপ্টা উত্তর- না।

ইকোসিস্টেম যে একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া তা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। ইকোসিস্টেমের একটি উপাদান হয়ে আপনি যদি অন্য একটি উপাদানের কোনোভাবে ক্ষতিসাধন করতে থাকেন তবে চূড়ান্তভাবে যে আপনি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টাকে খোলাসা করি। ধরুন, আপনি নিচে দাঁড়িয়ে পাঁচতলার ছাদে দাঁড়ানো আপনার একজন বন্ধুকে আঘাত করতে চান, ঠিক সেই অভিপ্রায়ে আপনি তার দিকে একটি ঢিল ছুড়ে মারলেন। ঢিলটি কিন্তু আপনার মুখে এসেই পড়বে, তাই নয় কি? এখানে ‘পরিবেশ’ টা ধরুন আপনার সেই বন্ধু; যাকে কি-না আপনি আঘাত করতে চান। আর আপনি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে পরিবেশ দূষণ তথা প্লাস্টিক দূষণ হয় এমন যে কাজটি করেন সেটি হল বলটিকে উপরের দিকে ছুড়ে মারার আপনার যে প্রয়াস সেটির স্বরূপ। এখন বাকি রইল বলটি আপনার উপর এসে পড়ার ব্যাপারটি, তাই তো? সমীকরণ খুবই সহজ। কার্যকরণ সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে বলটি যেমন আপনার উপর এসে পড়েছে ঠিক তেমনি মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেই আমরা একদিকে যেমন বায়ুদূষণে শীর্ষস্থান অর্জন করেছি অন্যদিকে প্লাস্টিক দূষণের ফলে মানব রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক- এর উপস্থিতিও মিলেছে। প্রখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী ব্যারো বলেন, ‘প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা হল সিদ্ধান্ত গ্রহণের সেই প্রক্রিয়া, যা কি-না মানুষের ক্রিয়াকলাপের দরুণ পরিবেশের উপর কি ধরনের প্রভাব পড়ে তা নির্ণয় করে এমনভাবে- যাতে করে পরিবেশের স্বাভাবিক যে ক্ষমতা তা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং সেই সাথে সাথে টেকসই মানব উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।’

টেকসই নগরী, টেকসই মানব উন্নয়ন যেটাই বলেন আমরা যদি আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন নাগরিকের মতো আচরণ না করি তবে এগুলো পাঠ্যপুস্তকের গ-ি পেরিয়ে কোনোদিনই বাস্তব রূপ নেবে বলে মনে হয় না। আপনি আতকে উঠতে বাধ্য হবেন, মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চিত্র যদি আপনার সামনে আনা হয়। এই যে এত এত দূষণ তার শতকরা ৮০ ভাগের বেশির জন্য দায়ী কিন্তু এই আমরা, আমাদের খামখেয়ালিপনা ও অসচেতন আচরণ।

মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন কোথায় নেই? এই প্রশ্নটিই বেশি যুক্তিসঙ্গত। কারণ গবেষণায় এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া থেকে গভীরতম মহাসাগর এর তলদেশ পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক- এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। আরো অবাক করা বিষয়- এটি যে শুধু মানব রক্তে নয়, শিশুর মলে নাকি আরো ১০ গুণ বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। আমরা খাদ্য হিসেবে যা গ্রহণ করি, পানীয় হিসেবে যা পান করি, এমনকি নিঃশ্বাসের সঙ্গে যা গ্রহণ করি সব কিছুতেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের মারাত্মক উপস্থিতি বিদ্যমান। সেই যে ১৮৫৫ সালে আলেকজা-ার পার্কস সর্বপ্রথম প্লাস্টিক আবিষ্কার করলেন সেই থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যা যা ব্যাবহার করি তার অধিকাংশই প্লাস্টিকের তৈরী। প্লাস্টিকের উপরে এই অতি নির্ভরতা আমাদের যেন কমছেই না বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে প্রসাধনী সামগ্রীতে যে মাইক্রোবিডস্- এর ব্যবহার হয় এটি আমাদের প্লাস্টিক নির্ভরতারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা না হয় বাদই দিলাম; আমরাই এই পৃথিবীর বুকে আর কতদিন সুস্থভাবে টিকে থাকতে পারবো কি-না সেটিই প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। যত্রতত্র আপনার-আমার ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক যে আগামী ৫০০ বছরেও পচনশীল নয় এটা জানার পরেও আমাদের পর্যটন এলাকাগুলোতে যে চিত্র চোখে পড়ে সেটি হতাশার বৈকি আর কিছুই নয়। যার ফলস্বরূপ আমাদের মাটি ও পানির প্রায় ৭০ ভাগ চরমমাত্রায় প্লাস্টিক দূষণের কবলে। এবার সেই পানি থেকে আপনি একটি মাছ উঠিয়ে খান বা সেই মাটিতে একটি গাছ লাগিয়ে আপনি তার ফল খান, যাই করেন- আপনি কিন্তু পরোক্ষভাবে সেই প্লাস্টিকই ভক্ষণ করলেন!আগেই বলেছি এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া; কাজেই আপনি কিছু করলে তার ফল তো আপনাকেই ভোগ করতে হবে, তাই না? যেই প্রকৃতিতে আমাদের বসবাস, আমাদের অস্তিত্বের খোরাক জোগায় যার উপাদান তার সাথে এহেন আচরণ ঠিক কতটা সমীচীন? আমরা হয়তো চাইলেই রাতারাতি এক লাফে জার্মানী বা অস্ট্রিয়ার মতো আমাদের প্লাস্টিক দূষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের দূষণকে শূণ্যের কোঠায় নিয়ে যেতে পারবো না, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে একধাপ এগিয়ে তো যাবো?

সামাজিক নিয়ন্ত্রণের দুইটি ধরন প্রতিষ্ঠিত। একটি হলো আনুষ্ঠানিক; যেটি আইন প্রয়োগের দ্বারা হয়ে থাকে। আর আনুমানিক সমাজিক নিয়ন্ত্রণ যেটি, সেটি সমাজের মূল্যবোধ এবং মূল্যবোধের সাথে আমাদের সমরূপতা এবং একটি বিশেষ বিশ্বাস পদ্ধতি। আনুমানিক সামাজিক নিয়ন্ত্রণ পুরষ্কার এবং নিষেধাজ্ঞার দ্বারা প্রয়োগ করা হয়। আমাদের দেশে প্লাস্টিক দূষণের এই যে চিত্র এটিকে বদলে দিতে হলে দুই ধরনের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির উপরই জোরালো গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।

সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই বিষয়ে ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’- এমন স্লোগানে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার এই তো সময়। প্লাস্টিক দূষণের ভয়াল থাবা এক এক করে জীবন কেঁড়ে নেওয়ার আগেই আমাদের সচেতন হতে হবে, গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

আমরা কি পারি না পলিথিনের বদলে আমাদের সোনালি আঁশ পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে? আমরা কি পারি না যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলা থেকে বিরত থাকতে? প্লাস্টিকের দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহার কমিয়ে আমরা কি পারি না বায়োডিগ্র্রেডেবল প্লাস্টিক ও কাচের ব্যবহার নিশ্চিত করতে? আমাদের সরকার কি পারেন না প্লাস্টিক দূষণ ব্যবস্থাপনায় প্রণীত আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে? সেই সাথে সাথে পরিবেশ সুরক্ষা নীতিকে বাস্তবতার নীরিখে আরো উন্নত করতে?

আবশ্যই সবই সম্ভব। আর এই সম্ভবতাকে বাস্তব রূপ দান করতে হবে এখনি। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার এই অঙ্গীকার হওয়া উচিত আমাদের সবার।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী এবং জাপানের সাকুরা সায়েন্স ক্লাবের সদস্য

মন্তব্য

Beta version