চাল-সহ প্রয়োজনীয় সকল পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং মূল্যবৃদ্ধির জন্য দোষারোপ ইত্যাদি কথা বারংবার শোনার পরেও যখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম ধরা যায় না কিংবা হয় না, জনগণ হতাশ হয়। করোনাভাইরাসের বক্রাঘাতে বিধ্বস্ত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনের করুণ দশায় যারা সহযোগিতার বদলে ক্রয়ক্ষমতা বা পণ্যের দাম নিয়ে ভিন্ন কথা বলেন, তারা হয়তো বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে বাস করেন। ভুক্তোভোগীই জানেন করোনা ও নিত্যপণ্যের মহামারীর পরিণতির ভয়াবহতা কী।
কথিত ‘পর্যাপ্ত মজুদ’ থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যের দাম বাড়ার কারণ প্রতিবছরের সাধারণ ঘটনা হলেও, তা খুবই রহস্যজনক এবং এই রহস্যের ভিতর দেশের মানুষ অনেকটা বাধ্যগত নাগরিক। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে নিরাপদ খাদ্য মজুদের পরিমাণ ১০ লাখ টন, সেখানে খাদ্যশস্যের মজুদ ২০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। অথচ প্রয়োজনীয় সকল খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিসহ সবজি ও কাঁচাবাজারের ঊর্দ্ধগতি ইতোমধ্যে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে। মূল্য স্বাভাবিক করার পরিবর্তে, পরোক্ষভাবে যুক্তি বা হুমকিও শোনা যায়, জিনিসপত্রের দাম না বাড়ালে আমদানি বন্ধ হয়ে যাবে, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে! এই অমোঘ পরিস্থিতি আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সাথে সাংঘর্ষিক না কি সহগামী!
পবিত্র রমজান মাস সংযমের মাস। সবার জন্য সংযম অবশ্য প্রযোজ্য নয়; বিশেষ করে, কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে। রমজানের শুরুর আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে চারিদিকে কথাবার্থা শুরু হয়েছে। বাজারে প্লাস্টিকের চাল পাওয়া যাচ্ছে! এরই মধ্যে খবরের কাগজের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছেন, ‘রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে’। এই রকম খবরে প্রথম দিকে মনে একটু আশা জাগে, যেন সত্য হয়! পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে আসে, এটাতো প্রতিবছরই শুনি। বাস্তবটাওতো জানি। এরকম সংবাদ কিংবা উপরমহলের আশ্বাস প্রতিবছরই শুভেচ্ছার মতো পাওয়া যায়, প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়; তবে তা অবশ্যই মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। কারণ ক্রয় ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে পণ্য পাওয়ার সুযোগ নেই; অন্তত, সাধারণ মানুষের জন্য। বিশ টাকার জিনিস একশো টাকা হলেও মানুষকে কিনতে হয়; কোনো পণ্য আগে যদি এক কেজি কেনা যেত, রমজান বা যেন উৎসবের আগে আগে গুনে গুনে ৫-১০ টা করে কেনা হবে; কম খাবে। তবু কেনার ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। কম খেলে কিচ্ছু হয় না; বেশি খেলে গলা ধরে; ওজন বাড়ে। এবার না হয় পাঁচটা করে পেঁয়াজ কেনা হবে, দুইটা করে বেগুন। গতবছর যদি তিন কেজি ছোলা কেনা হয়, এবার হয়তো দুই কেজি কেনা যাবে। অর্থাৎ পরিমাণ কমালেও কেনা বন্ধ হবে না। তাই বলা যায়, আসলেই তা ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে।
যারা বেশি পরিমাণে কিনতে পছন্দ করেন, তারা না-হয় গুণগতমানের প্রশ্নে কিছুটা ছাড় দিয়ে তুলনামূলকভাবে কম দামি জিনিস কিনবেন। ছাড়তো দিতেই হবে; হয় দাম কিংবা মান। তাই বলা যায়, দাম যাই-ই হোক-না কেন তা অবশ্যই ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বলে কেনাকাটার অভাবে না খেয়ে থাকার কারণে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। এটাই হয়তো আমাদের জন্য সব থেকে স্বস্তির; এবং একমাত্র সাস্ত¡নার বিষয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এবং তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কারোর নেই কিংবা আদৌ কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন কি-না সে ব্যাপারে জনগণের মনে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সুযোগ নাই; কারণ বিষয়গুলো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই রকমভাবে চলে আসছে।
তবে এই গোলোকায়নের যুগে মানুষ সবই জানে, সবই বোঝে; যদিও কিচ্ছুই করার নেই। এখন গ্র্রামের মানুষও জানেন, পৃথিবীর যে কোন দেশে যে কোন বড় ধরনের উৎসবের আগে নিত্যপণ্যের দাম, সৌখিন জিনিসপত্রের দাম এবং পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল দ্রব্যাদির দাম উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকে; বিশেষ ছাড় থাকে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের মানুষ বিক্রয়সেবা বা ক্রয়োৎসবের (সেল/sale) অপেক্ষায় থাকে। বিভিন্ন উৎসবের আগে অনেক দেশে বিশেষ বিশেষ সেল দেয়া হয়। বেশিরভাগ মানুষ, এমনকি ধনীরাও ঐ সেলের অপেক্ষায় থাকে এবং বেশিরভাগ মানুষই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, জুতা, জামাকাপড় সবকিছু সাধারণত সেল থেকে কিনে থাকে। কোনো কোনো দেশে সারা বছর ধরে সেল অব্যাহত থাকে; একেক এলাকায় একেক সময়; একেক মার্কেটে একেক সময়; পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যের ওপর।
অথচ বাংলাদেশে যে সময়টাতে মানুষের সঙ্কট প্রকট, সে সময়ে যে যে পণ্য অপরিহার্য, সেগুলোর দাম হাতের নাগালের বাইরে যাবেই। প্রতিদিন খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হবে নিত্য/অনিত্য পণ্যের ঊর্দ্ধগতি নিয়ে; কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হয় না। দাম তার নিজের ইচ্ছার বাইরে কারো কথায় কমে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতি এখন এমন ‘স্বাভাবিক ও সহনীয়’ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে এটার প্রতিকার অপেক্ষা, কোন পন্যের দাম কত এবং কোন পণ্য কতটুকু কেনা যাবে সেদিকেই মানুষের মূল আগ্রহ। এ লক্ষ্যে সংবাদপত্রগুলো নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমসমূহে আজকাল বাজারের জিনিসপত্রের দাম নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য বিশেষ প্রতিনিধিও থাকে। কারণ রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, বিনোদন বা খেলাধুলার মতো জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা; যা মানুষ জানতে চায়, তার সামর্থ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে কেনাকাটা করার জন্য, খাদ্যাভাস পরিবর্তনের জন্য। এ মাসে এক কেজি পেঁয়াজ কিনবে নাকি দশটা কিনবে; কিংবা এই শীতে সবজি খাবে, কী খাবে না। বেঁচে থাকলে পরের বার চেষ্টা করা যাবে!
বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার বাকবিতণ্ডা নিয়েও টিভি মাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়; তবে দাম বৃদ্ধিতে অভিযোগ বা প্রতিকারের চেয়ে আজকাল মানুষ কম কথা বলে। কারণ মানুষ জানে এসব বলে আর লাভ নেই। যারা মালিক, তারাইতো সিদ্ধান্ত নেন। তাই সাধারণ মানুষের ভিন্ন অবস্থান নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ টাকার জিনিস একশো টাকা হলেও মানুষ আর বেশি উচ্চবাচ্য করে না। দাম বাড়ছেতো বাড়ুক; একসময় নিশ্চয় কমবে; কিনতে না পারলে কিংবা কম কম খেলেতো আর মানুষ মরে না।
বস্তুত, দিনের পর দিন মানুষ এ সকল অনিয়ম দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং বুঝতে পেরেছে এ সমস্ত বিষয়ে কথাবার্তা বলা অর্থহীন। যারা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন, যারা পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের মূলধনকে বাড়াচ্ছেন মানুষকে শোষণ করে, সে শোষকদের মানুষ চেনেন। তারা ক্ষমতাবলয়ে অবস্থান করেন কিংবা ক্ষমতাবলয়ের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা ওৎপ্রোত। তাই মানুষ দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। চালের দাম বেড়ে গেলে আলু খাবে, আলুর দাম বেড়ে গেলে কচু খাবে, বাঁশ খাবে। মাঝে মাঝে ভোক্তা অধিকার সংগঠনের কথা টেলিভিশনে দেখা যায়, সংবাদপত্রে ছবিও প্রকাশিত হয়। তাদের দোষ দিয়েও লাভ নাই। তাদের প্রচেষ্টা থাকলেও, দ্রব্যমূল্যের ওপর কারো কোনো অধিকার নেই; নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবল নিত্যপণ্যের দাম কেন, বাড়ি ভাড়া, বাস ভাড়া সবই বাড়ে এই দেশে। এক অদ্ভুত ব্যাপার, যখন যেটার সঙ্কট বা প্রয়োজন, তখন সেটার দাম বাড়ে। এই দেশে ৫০ টাকার হ্যান্ডস্যানিটাইজারের দাম ১০০ টাকা হয়; এক টাকার প্যারাসিটামল পাঁচ টাকা হয়ে যায়; ১০০ টাকার বাস ভাড়া ১৫০ টাকা হয়ে যায়।
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এই দেশে পবিত্র রমজান কিংবা ঈদের আগে আগে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়ার কী কারণ? সাধারণ মানুষের মনে একটি প্রশ্ন, কেন প্রতিবছর রমজান মাসে ছোলা, দুধ, খেজুর এমনকি মুড়ির দাম বাড়ে? মধ্যপ্রাচ্যের কথা শুনতে পাই, সেখানে রমজান মাসে নামেমাত্র মূল্যে খেজুর, ফল, জামা-কাপড় সহ সকল পণ্য বিক্রি হয় । মধ্যপ্রাচ্যে রমজানের আগে থেকে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয় কোন সুপারস্টোর কত কমে (৩০-৭০ শতাংশ ছাড়ে) জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারে। আর বাংলাদেশে ঠিক তার উল্টো। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং যে সময়ে যে জিনিসের প্রয়োজন খুব বেশি সেটির দাম আকাশচুম্বী করা হয়। ইষ্পিত মুনাফা লাভের পর একসময় অনেক সমালোচনার পর দাম কিছুটা কমানো ও হয় আর অপরাধবোধ তো দূরের কথা চারিদিকে সব মহলের যেন উচ্চকণ্ঠ। নিয়ন্ত্রণের তো কোনো চেষ্টাই নাই, বরং জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা ও অভিযোগের সমালোচনা, দোষ চাপানো, ইত্যাদি।
এমতাবস্থায়, এ দেশে লুণ্ঠনকারী আর সাধারণ মানুষের কাছে উৎসবের তাৎপর্য এক নয়। যে কোনো উৎসব বা দুর্যোগে পুঁজিপতিদের লাভের উপর লাভ; আর সাধারণ মানুষকে তখন পরিমিত থাকতে হয়। অর্থাৎ, রোজার মাসে বাঙালি মুসলিমকে দিনেরাতে সবসময় পরিমিত থাকতে হয়; প্রথমত সিয়াম সাধন বা রোজা রাখার মাধ্যমে; আবার জিনিসপত্র কেনাকাটায় সংযম সাধনের মাধ্যমে। দুর্যোগের সময়ও তাই। তাই পুঁজিপতিদের কাছে উৎসবও যা, দুর্যোগও তা; সবকিছুতে লাভ। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ যাবতীয় দুর্দশা থেকে সাধারণের মুক্তির এমন সম্ভাবনা যেহেতু দৃশ্যমান নয়, তাই ভোগ সামলানো ও ধৈর্য্যধারণই হোক নিরুপায় জনসাধারণের সংযম সাধনের অন্যতম অনুষঙ্গ।
লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক
মন্তব্য