রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এরই মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি স্ফীত হয়ে উঠছে। সামরিক-বেসামরিক মানুষের লাশের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনীয়র সংখ্যা। বলা বাহুল্য, এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা ইউরোপে এক ধরনের নাড়া ও সাড়া পড়েছে। বিশ্নেষক, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। আমরা দেখেছি, পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর একের পর এক কঠিন অবরোধ আরোপ করেছে। এ যুদ্ধ স্বাভাবিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক নতুন যুগেরও সৃষ্টি করেছে। একদিকে পশ্চিমাদের জোটবদ্ধ হওয়া, অন্যদিকে রাশিয়ার দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধে নামার মানে হলো নতুন শীতল যুদ্ধ শুরু হওয়া; যেটা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখেছি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব-অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই। রাশিয়ার সুইফট সুবিধা বাতিলকরণ ও বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে যে মন্দাবস্থা এবং শেয়ার মার্কেটে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব বিশ্ব-অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে।তাছাড়া, এ যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব আরও প্রকট করে তুলেছে। বস্তুত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীন-রাশিয়ার মেরুকরণ ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বড় আকারে দেখা গেছে। জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পরও ন্যাটোর মাধ্যমে তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার জোট কোয়াড এবং অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জোট এইউকেইউএসও একই উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করছে। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে পশ্চিমারা পুতিনকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করছে। নতুন মেরুকরণ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য স্পর্শকাতর অঞ্চলের ব্যাপারে রাশিয়া তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আক্রমণ শুরু করে এর নাম দিয়েছেন ‘বিশেষ সামরিক অপারেশন’। চার কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউক্রেনে হামলা হয়েছে উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে। কিয়েভের পথে রশিয়ার সেনাবহর অবস্থান নেয়। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও তাতে যোগ দিয়ে রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভøাাদিমির পুতিনের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে। গত দুই দশক ধরে স্নায়ুযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত সামরিক জোট ন্যাটো যেভাবে পূর্ব ইউরোপে তার বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে, তাতে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে মস্কো বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের পরপরই ন্যাটোর বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত ওয়ারশ প্যাক্ট বিলুপ্ত হলেও ন্যাটো এখনও বিদ্যমান। স্বাভাবিকভাবেই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
এই যুদ্ধকে নানা দিক থেকে দেখার বিষয় রয়েছে। প্রথম বিষয়, যুদ্ধটি কেন শুরু হলো? রাশিয়াকে কেন এমন পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হলো, যেখানে যুদ্ধ থেকে তার আর ফেরত আসার জায়গা ছিল না? কেন রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নেরই সাবেক সদস্য ইউক্রেনের ওপর হামলা করতে বাধ্য হলো? বলা বাহুল্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ের সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ভূ-রাজনীতির খেলায় চারটি প্রধান অংশীজন রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইউক্রেন। বিশেষ করে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ক্রমবর্ধমান শত্রুতার কারণে বহু আগেই ইউক্রেনের এই পরিণতি লেখা হয়। ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে রাশিয়াপন্থী শাসক ভিক্টর ইয়েনুকোভিচকে অপসারণ, তাকে রাশিয়ার আশ্রয় প্রদান এবং ঘটনাক্রমে সেখানকার রাজনৈতিক পরিবর্তনে ইউক্রেন যে সংকটে আজকের পরিণতি তারই বহিঃপ্রকাশ। আমরা দেখেছি, ২০১৪ সালেই রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের দখলে নেয়। এর ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পূর্ব ইউক্রেন অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
স্বাধীন-সার্বভৌম জাতির ওপর হামলা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। বৈদেশিক নীতি ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইউক্রেন সংকটের গভীর ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। যে ইউরোপ স্নায়ুযুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গর্ব করে, তাদের হাতেই আমরা দেখেছি তৃতীয় বিশ্ব কীভাবে ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড়ে আবদ্ধ হয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ এখনও ঔপনিবেশিক শাসন ও পশ্চিমা শক্তির প্রভাবে ভুগছে। আফ্রিকার দেশগুলো যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আজ বিপর্যস্ত সেখানেও ইউরোপীয় শক্তির ভূমিকা রয়েছে। ইউক্রেন সংকটের আসল কারণ বুঝতে হলে ভূ-রাজনৈতিক কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।
প্রথমত, ইউরোপ সাবেক যুগোস্লাভিয়ার বিভক্তির মাধ্যমে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থানের স্থিতিশীলতা হারিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের প্রত্যক্ষ মদদে সাবেক যুগোস্লাভিয়া পাঁচটি দেশে বিভক্ত হয়। বলাবাহুল্য, জাতিগত বিভেদ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ের রাজনৈতিক অপশাসন আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুন কোনো বিষয় নয়। তারপরও স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই পশ্চিমা শক্তির ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে যেভাবে একটি রাষ্ট্রকে বিভক্ত করা হলো সেটি বলা চলে ভবিষ্যৎ রাশিয়া ও তার নেতৃত্বকেই সতর্ক করা। ওই ঘটনা দ্বি-মেরুর পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণই বেছে নিয়েছিল। যদিও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিমের বিরোধও সে অর্থে শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে, ওয়ারশ প্যাক্টের বিলোপ সাধনের মাধ্যমে ন্যটোর কোনো প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। বিশেষ করে, ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর পতনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে ন্যাটো তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছিল? ন্যাটো পূর্বদিকে নজর দিয়ে পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্র, যারা রাশিয়ার প্রতিবেশী ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের সদস্য করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। এর মাধ্যমে বস্তুত ন্যাটো রাশিয়ার জন্য হুমকি তৈরি করে। ক্ষমতায় থেকে পুতিন এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেননি।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার নিরাপত্তায় সরাসরি আঘাত হয় যখন দেশটির সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী প্রতিবেশী ইউক্রেন চলার ক্ষেত্রে বন্ধু হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকেই বেছে নেয়। ২০১৪ সালে ইউক্রেন পশ্চিমাদের সহযোগিতায় নির্বাচিত নেতাকে উৎখাত করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। ২০১৯ সালে সাবেক কমেডিয়ান জেলেনস্কি ইউক্রেনে রাশিয়াবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে একত্র করে। চতুর্থত, বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাওয়া ইউক্রেনের ভ্রান্তনীতি। বস্তুত পশ্চিমারাই সেখানে রাশিয়াবিরোধী নীতিতে জ্বালানির ভূমিকা পালন করেছে এবং ইউক্রেনের নিরপেক্ষ ভূমিকা ক্ষুণœ করেছে। পঞ্চমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটি ভূ-রাজনৈতিক বিষয় দুই দেশের মধ্যকার জাতিগত ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব। ফলে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া দোনবাসের জন্য ‘বিশেষ সামরিক অপারেশন’ বলে রাশিয়া এ যুদ্ধের অজুহাত দিতে পারে। মূলত, রাশিয়া সব সময়ই বলে আসছে, ইউক্রেনের উচিত পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখুক। কিন্তু ইউক্রেন সে পথে হাঁটেনি। হামলার পর ক্রেমলিন সেটাই বলেছে।
যে কোনো যুদ্ধের পেছনেই ভূ-রাজনৈতিক বিষয় বড় কারণ হয়ে ওঠে। পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউক্রেন বরাবরই রাশিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া এবং শক্তিশালী করার কারণেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ক্ষেপেছেন। ১৯৪৯ সালে যে ন্যাটো ১২টি দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছে; আজকে তার সদস্য সংখ্যা ৩০। ন্যাটো লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়াকেও তার সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। ইউক্রেন যখন ন্যাটোর সদস্য হতে চাইছে, পুতিন বিষয়টি রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলেই যুদ্ধে নেমেছেন।
যুদ্ধ বরাবরই বিধ্বংসী এবং সভ্যতাবিরোধী। ইউক্রেন তার শক্তিশালী প্রতিবেশী রাশিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে- এ সরল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেখার সুযোগ সামান্যই। বরং এটি এমন পরিস্থিতি যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার বছরের পর বছর ধরে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ব সংবাদমাধ্যম পশ্চিমাদের প্রভাবাধীন বলে রাশিয়াকে তারা কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। আমরা জানি, ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দিয়েছে। মার্কিন সেনারা দুই দশক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গত বছর আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। সিরিয়া, লিবিয়া ও কয়েকটি আফ্রিকার দেশ পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক খেলার শিকার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমাদের তেমনি আরেকটি কৌশলগত খেলা।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য
মন্তব্য