‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’। এটাই হলো বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি। আধুনিক বিশ্বে প্রত্যেক রাষ্ট্র একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য অপর রাষ্ট্রের সাথে অনুরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে। রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে। এজন্য অটো ভন বিসমার্ক বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ নীতির সম্প্রসারণই হলো পররাষ্ট্র নীতি।’ পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেরও নিজস্ব বৈদেশিক নীতি রয়েছে। সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা; এসব নীতি হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে। প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে। রা. সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণ বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে রাষ্ট্র সমর্থন করবে। পরিশেষে বলা যায়, বৈদেশিক নীতি হলো রাষ্ট্রের সেসব কার্যাবলির বিবরণী, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে। অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশ সব ধরনের বৈরিতার ঊর্ধ্বে থেকে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে রয়েছে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক। এক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক খাতে বাংলাদেশের স্বার্থেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে বা হচ্ছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই এগিয়ে যেতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম যুব শ্রমশক্তি, যেখানে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে।
একবিংশ শতাব্দীর কাজের জন্য যেসব বিষয়ে দক্ষতার প্রয়োজন হবে, পরবর্তী প্রজন্মের তরুণদের সেসব বিষয়ে দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে অন্য বেশ কয়েকটি অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া এক্ষেত্রে ভবিষ্যতের যে পূর্বাভাস রয়েছে সেখানেও বৈশ্বিক গড় অবস্থানের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া পিছিয়ে। আগামী ২০৩০ সালে শিক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সম্ভাব্য অবস্থা নিয়ে এডুকেশন কমিশনের সাথে মিলিয়ে ইউনিসেফ যে হিসাব দাঁড় করিয়েছিল তার ওপর তাদের বাংলাদেশকে আরো দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেছেন, ‘প্রতিদিন দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় এক লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে যাদের একত্র করলে একটি বিশাল খেলার মাঠের সমান হবে। এদের প্রায় অর্ধেকই একবিংশ শতাব্দীর কাজের জন্য সঠিক পথ নেই। দক্ষিণ এশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, যেখানে সীমিত সময়ে তাদের মেধাবী ও সক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে জনসংখ্যাগত উল্লেখযোগ্য সুবিধা তুলে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগালে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আর এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে, তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়বে এবং মেধা অন্য অঞ্চলগুলোতে হারিয়ে যাবে’।
দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে প্রায় ১৮০ কোটির বেশি মানুষ বাস করছে। এই জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকের বেশি ২৪ বছরের কম হওয়ায় ২০৪০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তরুণ জনশক্তি থাকবে দক্ষিণ এশিয়াতেই। এই সুযোগ অত্র অঞ্চলের অর্থনীতিকে প্রাণবন্তু ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতির পথে চালিত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ জোরদার করা হলে এই অঞ্চল শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে এবং একই সাথে আগামী দশকগুলোতে শিক্ষা ও দক্ষতা খাতে সুযোগ প্রসারিত হবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ৩২ হাজার তরুণ-তরুণীর ওপর পরিচালিত ইউনিসেফের ‘ভয়েসেস অব ইয়ুথ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক জরিপে ২৪ বছরের কমবয়সী এই তরুণদের আধুনিক অর্থনীতির জন্য কতটা ভালোভাবে তাদের প্রস্তুত করা হচ্ছে তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ কারণ হয়ে উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার অনেক তরুণ মনে করে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সেকেলে এবং এটা কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি করে না। তারা এমনকি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করার পরও কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে মূল বাধা হিসেবে কাজ করছে অভিজ্ঞতার ঘাটতি (প্রায় ২৬ শতাংশ), নিয়োগযোগ্যতা উন্নয়নে অপর্যাপ্ত সহায়তা সেবা (২৩ শতাংশ কোনো সহয়তা পায় না এবং বেশিরভাগই সমন্বিত সেবার পরিবর্তে খুবই সীমিত পরিসরে (সেবা পায়) এবং ঘুষ/বৈষম্যমূলক আচরণ ও অন্যায়ভাবে বা পক্ষপাতদুষ্ট নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার (৪৪ শতাংশ) কথা উল্লেখ করে। গ্লোবাল বিজনেস কোয়ালিশন ফর এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক জাস্টিন ভ্যান ফ্লিট বলেছেন, এটি একটি সংকট। দ্রুত বদলে যাওয়া শ্রমবাজারে সফলতার সাথে প্রবেশের জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে সবচেয়ে ভালোভাবে তৈরি করতে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের দক্ষতায় যে ঘাটতি রয়েছে তা নিরসনে সরকারি বিনিয়োগ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি, নাগরিক সমাজের অবদান এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক খাতে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটি অবশ্য একটা ইতিবাচক দিক। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তনও এসেছে। মাথাপিছু আয়, জিডিপি’র প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, যেখানে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৬ পয়েন্টের প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে কোনো দেশের পয়েন্ট ৩৬ এর বেশি হলে সেই দেশকে এলডিসিভুক্ত রাখা হয়, ৩২ এ আসার পর উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন হয়। সেখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। এক কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশ এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে। তবে এই তৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আরো অনেক দূর। প্রতিবেশী, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করে বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ অন্যান্য খাতে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বা বৈদেশিক নীতি হলো- আধুনিক বিশ্বে প্রত্যেক রাষ্ট্র একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি রাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য অপর রাষ্ট্রের সাথে অনুরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে। রাষ্ট্র প্রকৃত পক্ষে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে। এজন্য অটো ভন বিসমার্ক বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ নীতির সম্প্রসারণই হলো পররাষ্ট্র নীতি।’ পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেরও নিজস্ব বৈদেশিক নীতি রয়েছে। এসব নীতি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। আর সেই ভিত্তিকে নির্ভর করেই পার্শ্বর্বর্তী দেশগুলোর সাথে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার রয়েছে কয়েকটি বড় অর্থনীতির দেশ। সেসব দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানও বাড়বে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা ত্বরান্বিত হবে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক: বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড
মন্তব্য