-->
যাকাত

বছরে দশ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন সম্ভব

এস এম মুকুল
এস এম মুকুল
বছরে দশ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন সম্ভব
দেশের যাকাত বোর্ড ও ইসলামী ফাউন্ডেশন কর আদায়ের মতো করে যাকাত আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ দেশে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অগণিত সফল ব্যবসায়ী, বিত্তবান, ধনাঢ্য, শিল্পপতি রয়েছেন। যাদের কাছে কোটি কোটি টাকা এখানে-সেখানে গচ্ছিত কিংবা অলস অবস্থায় বছরের পর বছর পড়ে থাকে। সমাজের ধনী মানুষেরা যদি গরিব মানুষের কল্যাণে তাদের অর্জিত অতিরিক্ত সম্পদের ৪০ ভাগের অন্তত ১ ভাগ যাকাত হিসেবে ব্যয় করেন তাহলেও দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে- নিঃসন্দেহ বলা যায়। ‘ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ’-এর নির্বাহী পরিচালকের একটি সাম্প্রতিক লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, সঠিকভাবে দেশের বিশ লাখ ধনীর কাছ থেকে যাকাত সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হলে বছরে দশ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা সম্ভব। তিনি আরো লিখেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে, গরিব-ভিক্ষুক পুনর্বাসনে যাকাত তহবিলের মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনা নেয়া হলে মাত্র এক দশকেই দেশের দারিদ্র্যমুক্তি সম্ভব। অর্থনীতিবিদরাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। প্রতি বছর দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়নে শত শত কোটি টাকার বাজেট থাকে। অথচ যাকাতের মতো বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিকটি গুরুত্ব পায় খুবই কম।

দেশের যাকাত বোর্ড ও ইসলামী ফাউন্ডেশন কর আদায়ের মতো করে যাকাত আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ। একটি মুসলিম দেশে ইসলামের বিধান অনুসারে যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থপনা থাকাটাই স্বাভাবিক। এখানে যাকাত আদায়ের লক্ষ্যে সক্ষম ধনীদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে বিভাগ, জেলা ও থানাভিত্তিক ‘যাকাত আদায় কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে।

বিশ্বের শীর্ষ ১০০ ধনী বছরে যে আয় করেন তা দিয়ে বিশ্বের চরম-দারিদ্র্য ৪ বার দূর করা সম্ভব। ‘দ্য কস্ট অব ইনইক্যুয়ালিটি : হাউ ওয়েলথ অ্যান্ড ইনকাম এক্সট্রিমস হার্ট আস অল’ শিরোনামে ব্রিটেন ভিত্তিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের দারিদ্র্য দূর করতে যে পরিমাণ অর্থ দরকার, শীর্ষ ১০০ জন ধনীর কাছে তার চারগুণ অর্থ রয়েছে। অক্সফামের গবেষণা বলছে, অল্প কিছুুসংখ্যক লোকের সীমাহীন সম্পদ দারিদ্র্য দূরীকরণের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবতাও আসলে তা-ই। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে সহায়তা চাওয়া হলে দেশে বিত্তবান মানুষেরা সাগ্রহে এগিয়ে আসেন। তাতে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের মানবিক ও ধর্মীয় অনুভূতি যথেষ্ট সক্রিয়। একটি সুন্দর-পরিচ্ছন্ন নীতিমালায় স্বচ্ছতার সাথে যাকাত আদায় এবং আদায়কৃত যাকাতের অর্থ ব্যবহার-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে দেশের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভব হলে প্রতি বছর ‘হাজার কোটি’ জমা হতে পারে এই ফান্ডে। ভারতে পিস টিভি অব ইন্ডিয়া পরিচালিত হচ্ছে যাকাতের সহায়তায়। অর্থাৎ, বাংলাদেশেও যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু হলে দারিদ্র্য বিমোচন, পথশিশুদের আবাসনভিত্তিক শিক্ষা, এতিমখানা, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন, ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা, বিপথগামীদের আলোকিত পথে নিয়ে আসা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা, আত্মকর্মসংস্থান প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। আর এসব কার্যক্রমে নিজস্ব প্রচার সৃষ্টি করে যেমন: পত্রিকা-টিভি চ্যানেলে প্রচার করার ব্যবস্থা করা গেলে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ‘আদল’ পরিপূর্ণতা পেতে পারে।

এটা সবারই জানা, সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে পবিত্র ইসলাম ধর্মে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন আয়াতে বহুবার সরাসরি যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, শতকরা ৮৫ ভাগ মুসলমানের দেশে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু হলে ৫ বছরে দারিদ্র্য অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বলা হয়েছে, দেশে ৫ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের নিজস্ব সম্পদ বলতে কিছু নেই। আবার ২৭ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের মালিকানায় সম্পদের পরিমাণ এক একরের কম। পক্ষান্তরে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের কাছে ভোগ-দখলের উপজীব্য হয়ে আছে ৯৫ শতাংশ সম্পদ। দেশের মোট জমির ৮০ ভাগ এই শ্রেণির দখলে!

সম্পদ শুধু ধনীদের মধ্যে আবর্তিত হলে সামাজিক বৈষম্য কখনো কমবে না। দারিদ্র্য বিমোচনও সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে যাকাত হলো একটি বুনিয়াদি অর্থনৈতিক দর্শন। মানুষ যত ধনীই হোক- তাকে চারপাশের মানুষের কথা ভাবতে হবে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও সমাজের কথা তাদের ভাবতে হবে। এককভাবে ভোগের মাঝে কোনো আনন্দ নেই। নিজের অর্জিত সম্পদ বংশপরম্পরায় ভোগ-বিলাসের জন্য জমা রাখার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। এতে জেনারেশনের মাঝে উত্তরাধিকারী কর্তৃত্ব যতটা জেঁকে বসে, নিজে কাজ করে সম্পদ আহরণে ততটা আগ্রহ থাকে না। এ কারণে ইসলাম গরিব-অসচ্ছল ব্যক্তিদেরকে সচ্ছল বানানোর দায়িত্বও অর্পণ করেছে ধনীদের কাঁধে। যাকাত আদায়ে স্বনির্ভর, বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এই ব্যবস্থাপনাকে যাকাত বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে মসজিদভিত্তিক যাকাত বিষয়ে সচেতনতা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। সমন্বিত প্রচেষ্টায় যাকাতের মাধ্যমে একটি শ্রমমুখী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি নিজ নিজ এলাকার গরিব ও সামর্থ্যহীন আত্মীয়-স্বজনকে দোকান-পাট, কুটির শিল্প, নৌকা, ট্রলার, ভ্যান গাড়ি, মাছ ধরার জাল, রিকশা বা কোনো উপার্জনমুখী ব্যবস্থা দান বা সহায়তা করেন তাহলে সামাজিকভাবে সর্বোপরি রাষ্ট্রের মাঝে ধনী-দরিদ্রের বিস্তর ব্যবধানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষেরা যদি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন তাহলে সমাজ থেকে বস্তিবাসী, ছিন্নমূল, টোকাই, পথশিশু- এ জাতীয় নির্মম মানবতার শব্দগুলো বিলুপ্ত হবে। মোট কথা, এভাবে আমরা আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের মাধ্যমে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন আনতে পারি। আর এর এজন্য শুধু ধনের নয় মনের দারিদ্র্যও দূর করা দরকার। ধনবানরা যেন গরিব মানুষদের কল্যাণমুখী কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেন। ধনী মানুষের যাকাতের টাকা দিয়ে দরিদ্র মানুষদের জন্য উপার্জনমুখী উদ্যোগ নেয়া যায়। প্রত্যেকে নিজের এলাকার দরিদ্রতা নিরসনে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়া গেলে যাকাতের প্রকৃত আদর্শ প্রতিপালন করা হবে।

লেখক: কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক, উন্নয়ন গবেষক এবং কলাম লেখক

মন্তব্য

Beta version