কোভিড-১৯ এবং জলবাযু পরিবর্তন দুইটি বৈশ্বিক সংকট এবং উভয়ই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ এশিয়ায় টেকসই কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তন-এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের অনেক অঞ্চলে খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কোভিড-১৯ কৃষি কার্যক্রম এবং সরবরাহ শৃঙ্খলাকে আরো ব্যাহত করেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের দেখিয়েছে যে, এই পরস্পর নির্ভর বিশ্বে ‘সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়’।
দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৬০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দক্ষিণ এশিয়ার কৃষকরা বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি এবং পৃথিবীর কৃষিজমির মাত্র ৫ শতাংশ দিয়ে তাদের কৃষি উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই অঞ্চলের দেশগুলো কোভিড-১৯ অতিমারির আগেই খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং অনুন্নত জনস্বাস্থ্যসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ এখনো মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীন এবং এই অঞ্চলে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের ৩৬ শতাংশ অপুষ্টির কারণে হতবুদ্ধির শিকার এবং ১৬ শতাংশ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। বিশ্বের হতবুদ্ধি শিশুদের প্রায় ৪০ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ায়।
বৈশ্বিক উষ্ণতা খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন এবং হিমবাহের ত্বরিত গলন দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন করোনা ভাইরাস দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষি কার্যক্রম, পরিবহন এবং বিপণনকে প্রভাবিত করেছে, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যের প্রচলিত চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো জটিল করে তুলছে। এটির ধাক্কা থেকে মুক্ত করার জন্য জুতসই পরিকল্পনা প্রয়োজন। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং নেপাল করোনা ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জটিল মিথস্ক্রিয়া খাদ্যনিরাপত্তার ছয়টি মাত্রাকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছে, যথা, খাদ্যপ্রাপ্যতা, প্রবেশাধিকার, স্থিতিশীলতা, ব্যবহার, সংস্থা এবং স্থায়িত্ব। উল্লেখ্য যে, এইচএলপিই গ্লোবাল ন্যারেটিভ রিপোর্ট সম্প্রতি খাদ্যনিরাপত্তার আরো দুইটি মাত্রা যুক্ত করেছে তা হলো-সংস্থা (এজেন্সি) এবং স্থায়িত্ব (সাসটেইন্যাবিলিটি)। দক্ষিণ এশিয়ার কৃষকরা এখন যুগপৎভাবে যে দুটো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা পরীক্ষা করে মোকাবিলা করা দরকার যা নিম্নোক্ত উপায়ে করা যেতে পারে-
১. স্বাস্থ্য খাত শক্তিশালীকরণ: কোভিড-১৯ এবং স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার মতো অতিমারি মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্য খাতের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা দরকার। জরুরি পরিকল্পনা প্রস্তুত করা এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার কার্যকারিতা তৈরি করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যাতে মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং খাদ্য উৎপাদন ও পরিবহন নিরাপদে পরিচালনা করা যায়। কোভিড-১৯ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য হুমকির বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার, পানি এবং স্যানিটেশন প্রয়োাজন।
২. অতিমারির জন্য কৃষিকে প্রতিরোধী করা: কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের শিখিয়েছে যে, একটি জরুরি অবস্থা অপ্রত্যাশিতভাবে উদ্ভূত হতে পারে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে। একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য স্থানীয় এবং আঞ্চলিক খাদ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং স্বল্প সরবরাহ শৃঙ্খল যাতে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখা। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বেকারদের কর্মসংস্থান প্রদানের জন্য ভুটান সরকার শহুরে এবং পৌর-শহুর এলাকায় কৃষিকে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবজি ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনের জন্য পতিত জমি ব্যবহার করতে সরকার বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করেছে।
৩. সামাজিক নিরাপত্তা জাল বিস্তৃত ও শক্তিশালীকরণ: দুর্বল সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য সামাজিক সুরক্ষা জাল বিস্তৃত ও শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ। যথাসম্ভব পর্যাপ্ত জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রদান করা উচিত, এই ধরনের জনসাধারণের বিতরণকে স্থানীয় ও আঞ্চলিক খাবারের সঙ্গে একীভূত করে কাজ করা উচিত। যেখানে সরবরাহ শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, সেখানে শিশু ও মহিলাসহ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সমর্থন করার জন্য বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
৪. নমনীয় ও স্মার্ট পন্থা অবলম্বন: স্বাভাবিক খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য স্মার্ট পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি শ্রমের সোর্সিং, শ্রমের গতিশীলতা এবং কাজের সময় বৃদ্ধিতে নমনীয়তা দরকার। উদাহরণস্বরূপ, শিফটের সংখ্যা বৃদ্ধি করা বা যেখানে সম্ভব সেখানে কাজের সময় পরিবর্তন করা দরকার। উন্নত স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির নিশ্চয়তার জন্য অস্বাস্থ্যকর খাবারকে নিরুৎসাহিত করা এবং পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যকে উৎসাহিত করা উচিত। যেখানে সম্ভব, স্থানীয় শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগকে হতাশ না করে মানব শ্রমিকদের পরিবর্তে কৃষি যান্ত্রীকীকরণে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ সরকার ধান কাটার সময় শ্রমিকসংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য, হারভেস্টার কিনতে ভর্তুকি প্রদান করেছিল। এটি খাদ্য আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাবে। শহুরে দরিদ্রদের জন্য আরো বৈচিত্র্যময় এবং পুষ্টিকর খাবারের অ্যাক্সেস নিশ্চিত করতে হবে যা জীবিকা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৫. অতিমারির সময় সাপ্লাই চেইন চলমান এবং কার্যকরী রাখা: অতিমারি চলাকালীন খাদ্য ও কৃষি উপকরণগুলোর চলাচল নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষকে বিশেষ চ্যানেল এবং মানসম্মত কার্যকর পদ্ধতিগুলো চিহ্নিত করে এর বিকাশ ঘটাতে হবে যাতে সরবরাহ শৃঙ্খল চলমান এবং কার্যকরী থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ সরকার ধান কাটার সময়কালে কৃষি শ্রমিকদের পরিবহন নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। যা ফসলের ক্ষতি কমাতে সাহায্য করেছে। স্থানীয় সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং প্ল্যাটফরমকে শক্তিশালী করা উচিত। সরকারকে স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় স্তরে উন্নত আঞ্চলিক বাজারের অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা উচিত এবং সংক্ষিপ্ত সরবরাহ শৃঙ্খল এবং আঞ্চলিক বাজারসহ আরো বৈচিত্র্যময় এবং স্থিতিস্থাপক বিতরণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করা উচিত। ধাক্কা মোকাবিলার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো আমদানির উেস বৈচিত্র্য আনা এবং সরবরাহের ব্যাঘাত ঘটলে ভঙ্গুরতা কমানোর লক্ষ্যে একক উেসর ওপর নির্ভর না করা।
৬. অভিযোজন পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া: কৃষি এবং খাদ্যব্যবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে, সুনিপুণ ব্যবস্থাসহ একটি উপযুক্ত অভিযোজন পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা পারস্পরিকভাবে শক্তিশালী করে। অভিযোজন ব্যবস্থাগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের পাশাপাশি কৃষকদের জীবিকা এবং অভিযোজিত ক্ষমতা উন্নত করার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। উপযুক্ত ফসল ধারা, কৃষিতাত্তি¡ক ব্যবস্থাপনা এবং সম্পদের টেকসই ব্যবহারসহ ইকোসিস্টেম সংরক্ষণে টেকসই সমাধান গ্রহণ করা দরকার।
৭. টেকসইতার উন্নতি: টেকসইতা খাদ্যনিরাপত্তার অন্যতম প্রধান মাত্রা। কৃষিতে রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ জল এবং শক্তির অস্থিতিশীল ব্যবহার উচ্চ নির্গমন, জলদূষণ, বায়ুুদূষণ, পানির অভাব, শক্তির অভাব, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। জিএইচজি নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য কৃষিতে টেকসইতা বৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং ট্রেডিংয়ে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা দরকার। জ. উৎপাদনশীলতা ও সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা উন্নত করা : উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদনের ব্যবধান কমাতে, সম্পদ সংরক্ষণে ও ব্যবহারে দক্ষতা উন্নত করতে দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোকে কৃষি এবং খাদ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা উচিত। রাসায়নিক সার এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে পরিবেশগত সহ-বেনিফিট উৎপন্ন করার সময় স্থানীয়ভাবে উপযুক্ত ফসলের ধরন এবং উপযুক্ত কৃষিব্যবস্থা নির্বাচন করা এবং বহু-ফসল পদ্ধতিসহ ভূমি ব্যবহারের দক্ষতা ও ফসলের উৎপাদনশীলতা উন্নত করা যেতে পারে।
৮. একটি সক্রিয় পরিবেশ তৈরি করা: দুর্বলতা ম্যানেজ করার জন্য অনুকূল কৃষিনীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সরকারের নীতি, আর্থিক বিনিয়োগ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সমন্বয়করণের মাধ্যমে সক্ষম পরিবেশ তৈরি করা উচিত। কোভিড-১৯-এর সময় সরবরাহ চেইন কার্যকর রাখার জন্য ভ্যালু চেইন অ্যাক্টরদের সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা উচিত যাতে তারা পর্যাপ্তভাবে ভবিষ্যতে মহামারি এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
৯. গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে শক্তিশালী করা:গবেষণা ও উদ্ভাবন খাদ্যব্যবস্থার দক্ষতা স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার উন্নয়ন করার জন্য উন্নত গবেষণা, জ্ঞান এবং উদ্ভাবনের জন্য সরকারের অর্থায়ন করা উচিত যা পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে, জনস্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করে এবং সম্পদ সংরক্ষণ, ইকোসিস্টেমকে রক্ষা করে এবং গ্রিনহাউজে গ্যাস নিঃসারণ কমাতে সাহায্য করে। টেকসই উন্নয়নের জন্য কৃষি ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যব্যবস্থার উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপযুক্ত অভিযোজন এবং প্রশমন পদ্ধতিগুলো চিহ্নিত করার জন্য গবেষণার প্রয়োজন। গবেষণার ফলাফল যেমন খরা বা তাপ-প্রতিরোধী ফসলের জাতগুলোও কৃষকদের কাছে ব্যাপকভাবে এবং দ্রুত পৌঁছানো উচিত। এর জন্য উদ্ভাবনী জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি-খাদ্যব্যবস্থার উন্নয়নে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মসূচি শক্তিশালীকরণ প্রয়োজন।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি
মন্তব্য