-->
শিরোনাম

আত্মহত্যা: জীবনের পরিসমাপ্তিতে যে কষ্টের সূচনা

তামান্না তাসকীন
তামান্না তাসকীন
আত্মহত্যা: জীবনের পরিসমাপ্তিতে যে কষ্টের সূচনা
জীবনে যত কষ্টই আসুক না কেন মনে রাখা দরকার যে, তা কখনোই জীবনের থেকে বড় হতে পারে না

আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে কৈশোরকালীন বয়সে বাংলাদেশের অন্যতম সফল নায়ক সালমান শাহর আত্মহত্যার খবরটি পত্রিকায় পড়ার পর কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখেছিলাম। এ ঘটনায় সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তার রেশ কাটতে অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল। সেই সময়টাতে আত্মহত্যার বেশিরভাগ ঘটনা বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, সংসারে অশান্তি বা পাবলিক পরীক্ষার ফল বিপর্যয় ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ঘটে থাকত। সেক্ষেত্রে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজের ব্যর্থতার দায়ভার থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আত্মহত্যার কারণ ও বিস্তার এতটাই বেড়েছে যে, এখন এই বিষয়টিকে মহামারির সাথে তুলনা করা যায়। এক্ষেত্রে আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা ব্যক্তি তার সমস্যার প্রভাব থেকে পরিবারকে বাঁচানোর জন্য সমাজের প্রচলিত ধারণার বিপরীতে যাবার একমাত্র উপায় হিসেবে আত্মাহুতিকে বেছে নিচ্ছে। আমাদের পরিচিত পরিম-লে আত্মহত্যার ঘটনা এখন নিয়তই ঘটছে। গণমাধ্যমে যতটুকু আসছে বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যার ঘটনা অনেক সময় পরিবার প্রকাশ হতে দিতে চায় না। আবার ক্ষেত্রবিশেষে পরিবার এটিও মনে করে যে, আত্মহত্যার খবর প্রকাশ হলে পারিপাশ্ব্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবারের প্রতি বদলে যেতে পারে।

পরিসংখ্যানগত দিক থেকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনাকালে আত্মহত্যা বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের মতে এই সংখ্যা ৪৫ শতাংশ। মোট আত্মহত্যাকারীর ৮৩ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের চিত্রটি এক্ষেত্রে আরো ভয়ানক। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১৮ সালে ১০,১৫৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল এবং গড়ে দৈনিক ১ থেকে ২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে যার অন্যতম প্রধান কারণ বেকারত্ব।

পরীক্ষায় পাশ করা আর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য পেশাগত সাফল্য নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত বর্তমান যুব সমাজের সামনে হাতছানি দেয় অজানা আশঙ্কা আর চরম হতাশা। এজন্য তারা আত্মহত্যাকে সমস্যা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হিসেবে ভাবার কারণে জীবনের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলে আত্মবিশ^াস নেতিবাচক হয়ে যায়। ফলে বেঁচে থাকাকে আর আশীর্বাদ মনে হয় না। তার চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ ও আকাক্সিক্ষত হয়ে দাঁড়ায়। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে একটা বড় অংশ আবার হতাশায় আক্রান্ত থাকে। ফলে নেতিবাচক চিন্তার প্রাধান্য থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে না। এজন্য নেতিবাচক আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

আত্মহত্যার হাজারটা কারণ থাকতে পারে কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য আত্মবিশ্বাস নামক একটি শব্দই যথেষ্ট। সমস্যা আসবেই কিন্তু তাকে সমাধান করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা শুধু মানুষকেই দিয়েছেন। ইতিবাচক মূল্যবোধ চর্চার কোনো বিকল্প নেই। যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া, ধর্মীয় চেতনাবোধ, সত্য চর্চার মানসিকতা, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা, গুনগত সময় ব্যয় করা হতে পারে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোতে আত্মহত্যার খবর ফলাও করে প্রচার করার বিষয়ে আরো সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত। পূর্বের পাঠ্যবইয়ের পাতায় লেখা লাইনগুলো যেমন- গুরুজনকে সম্মান করো, ছোটদের স্নেহ করো, ক্ষমা মহৎ গুণ, অন্নহীনকে অন্ন দাও, মিথ্যা বলা মহা পাপ ইত্যাদি নীতিবাক্যগুলো আজ শুধু ট্রাকের পেছনে দেখা যায়। নীতিবাক্যকে ধারণ করার জন্য সুস্থ বিনোদন চর্চার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। পূর্বের মতো পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব, লাইব্রেরি গঠন করার উদ্যোগ নীতিহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। পাশাপাশি সন্তান বাবা-মার জীবনে আশীর্বাদ এ কথাটি সন্তানকে বোঝানোর দায়িত্ব অভিভাবকদের। সন্তানকে ভালো কাজে উৎসাহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বাড়ানো, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন। সমাজ একদিনে পরিবর্তন হবে না। কিন্তু পরিবার থেকে যদি ভালোবাসার বীজ বপন না করা যায় তাহলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সফলতা প্রত্যাশা করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় মাত্র। পরিশেষে বলতে চাই, আত্মহত্যা মানব সৃষ্ট দুর্যোগ যার সমাধান মানবের হাতেই। জীবন সুন্দর আর বেঁচে থাকাটা আশীর্বাদ। যার মৃত্যু যখন হওয়ার তখনই হবে। তাই জীবনে যত কষ্টই আসুক না কেন মনে রাখা দরকার যে, তা কখনোই জীবনের থেকে বড় হতে পারে না। সময়ে সব সমস্যাই ম্লান হয়ে যায়। শুধু দরকার ধৈর্য সহকারে তাকে মোকাবিলা করার। যে জীবনকে শেষ করে দেয়াটাই আত্মহত্যাকারীর কাছে একমাত্র সমাধান বলে মনে হয় আদতে তা আরেকজনের কাছে সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষিত। তাই সমস্যাকে নয় আমাদের উচিত বেঁচে থাকাকে গুরুত্ব দেয়া। কারোর জীবনের বিকল্প কোনো কিছু হতে পারে না।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

মন্তব্য

Beta version