-->
সবিশেষ

ঈদে নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা যেন খাতা-কলমে না থাকে

ঈদে নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা যেন খাতা-কলমে না থাকে
নৌ-সড়ক-রেল-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যথাযথ সমন্বয় হলেই নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব- এতে কোনো সন্দেহ নেই

রাজধানী ঢাকায় এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর একটা বড় অংশের স্থায়ী ঠিকানা গ্রাম। বেশিরভাগ মানুষ জীবিকার প্রয়োজনেই শুধু এই শহরে নানা সংকট মোকাবিলা করে টিকে আছেন। আসন্ন ঈদে কোটি মানুষের বেশি সড়ক, নৌ ও রেলপথে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরবেন। তবে সড়কপথে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাড়ি ফেরেন। রাজধানী ঢাকা থেকেই বেশি মানুষ গ্রামে যায়। এরপর চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলা। এক সঙ্গে এত মানুষ যদি বাড়ি যায়, তবে পরিবহণ সংকট হবে। রাস্তায় যানবাহন পেতে সমস্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। কেমন হবে এবারের ঈদযাত্রা? সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন তো। নাকি অন্য বছরের মতো নিরাপদ ঈদযাত্রার বেশিরভাগ পরিকল্পনা শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে। আর দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে প্রিয়জনদের কাছে ছুটতে হবে সবাইকে। এ নিয়ে আগেভাগেই কপালে চিন্তার ভাজ অনেকের। নিরাপদ ঈদযাত্রার জন্য সবার আগে নৌ-সড়ক-রেলপথ অপরাধমুক্ত রাখার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মহানগরীকেও রাখতে হবে অপরাধমুক্ত। স্টেশন, আশপাশের এলাকা বা যানবাহনে যেন কেউ অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, ছিনতাই, ডাকাতির শিকার না হন।

রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএতে জনবল একেবারেই অপ্রতুল। ঢাকার বাইরে সড়ক-মহাসড়কে পরিবহণ নিয়ন্ত্রণে লোকবল নেই। রাস্তার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিরসনে কাজ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সেখানে অর্থ বরাদ্দের যেমন ঘাটতি আছে, তেমনি আছে জনবল সংকটও। সড়ক মেরামত বা প্রকৌশলগত ত্রুটি নিরসনে আছে উদাসীনতাও। নৌপথ নিয়ন্ত্রণে বিআইডব্লিউটিএসহ যেসব দায়িত্বশীল সংস্থা রয়েছে, সেখানে জনবলের ঘাটতি আরো বেশি। রাস্তায় তদারকির দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশ ও নৌ-পুলিশের সংখ্যাও একেবারেই অপ্রতুল। ঈদ উপলক্ষে বছরের পর বছর রেলের অগ্রিম টিকিট কিনতে যাত্রীদের মহাভোগান্তির চিত্র সবার জানা থাকলেও সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সব মিলিয়ে ঈদের তিনদিন আগে থেকে সড়ক-নৌ ও রেল তিন পথই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যথারীতি পথে পথে মহাভোগান্তির শিকার হতে হয় ঘরমুখো মানুষকে।

ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকা থেকে যাত্রী পরিবহণের শুরু হয় প্রতিযোগিতা। তা ছাড়া একই সময়ে সব প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়। তাই এবারের ঈদকে সামনে রেখে সরকারি ছুটি শুরুর অন্তত তিনদিন আগে গার্মেন্টস ছুটি দেওয়া যেতে পারে। যদি রেশনিং পদ্ধতিতে ছুটি দেওয়ার বিষয়টি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আলোচনায় আনা হলেও, কার্যকর হচ্ছে না। ফলে শ্রমিককে নানা ভোগান্তি পাড়ি দিয়ে উৎসবে যোগ দিতে হয়। ঈদের অন্তত ১৫ দিন আগে দেশের সকল সড়ক যানবাহন চলাচলের উপযোগী করতে সড়ক বিভাগকে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। বৃষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখেই টেকসই সড়ক মেরামত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সড়ক-মহাসড়কের পাশ থেকে অবৈধ স্থাপনা, বাজার, টার্মিনালও উচ্ছেদ করতে হবে। অনুমোদনহীন যানবাহন যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আইন মেনে যেন যানবাহন চলাচল করে, তা নিশ্চিত করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হবে।

বাসে যত্রতত্র যাত্রী উঠানো, বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধ, সিটি পরিবহণগুলো যেন হাইওয়েতে কোনোভাবেই উঠতে না পারে, সেদিকে রাখতে হবে সতর্ক নজরদারি। ট্রাক, পিকআপ, নসিমন, করিমনসহ অনুমোদনহীন যানবাহনে যাত্রী পরিবহণ ঠেকাতে না পারলে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়বে। লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালনা ঠেকাতে হবে। পরিবহণে নৈরাজ্য ঠেকাতে একটি কার্যকর ভিজিল্যান্স টিম নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার-মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের। প্রতিটি হাইওয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উদ্ধারকারী টিম, অ্যাম্বুলেন্স, রেকার রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজনে হাইওয়ে পুলিশ, থানা-পুলিশ, আনসারের সঙ্গে র‌্যাব ও বিজিবি নামাতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সিটি ক্যামেরা স্থাপন করা, ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা প্রয়োজন। ছাদে যাত্রী পরিবহণ ঠেকানোর বিকল্প নেই। প্রতিটি জেলা ও থানাকে নিজ নিজ এলাকার সড়ক-মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশ দেওয়াও জরুরি। এসব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হলে সড়কপথে মানুষ নিরাপদে উৎসবে যোগ দিতে পারবেন।

নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে, ৫০ বছরে দেশে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২০ হাজার ৫০৮ জন। ৫০ বছরে দেশে ২ হাজার ৫৭২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪১৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ঈদে নৌ-দুর্ঘটনার ব্যাপারে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ নদীপথে বাড়ি যাবে। প্রতিটি নৌযানে যাত্রী নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে কিনা তা দেখা জরুরি। লক্কড়ঝক্কড় কোনো নৌযান যেন উৎসবে মৃত্যুর কারণ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় থেকে ঈদকে কেন্দ্র করে যেসব নির্দেশনা জারি হবে, উৎসবের আগে-পরে অন্তত ১০ দিন এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা গেলেই সফলতা।

নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানগুলোর নিবন্ধন নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিবছর ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করতে হয়। এ সনদ দিতে নৌযানের মাস্টার-ড্রাইভারের সনদ, জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম ও অন্য আনুষঙ্গিক বিষয়সহ ৫১টি বিষয় দেখেন নৌ-পরিবহণ অধিদপ্তরের সার্ভেয়াররা। সেদিক দেখভালের শিথিলতা চরমে। তাই দায়িত্বশীলদের দ্রুত সময়ের মধ্যে তা নিশ্চিত করাও খুব বেশি প্রয়োজন। শুধু ঢাকা নদীবন্দর বলে কথা নয়; অন্যান্য পথেও নিতে হবে একই ব্যবস্থা। পাশপাশি নৌঘাটে দুর্ঘটনা রোধে নৌ-পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থার বাহিনীকেও যুক্ত করতে হবে। নৌ-টার্মিনালে যেতে সড়কগুলো যানজটমুক্ত রাখাও প্রয়োজন।

রোজা শুরুর ১০ দিন পরই শুরু হয় রেলপথের অগ্রিম টিকিট বিক্রি। এবার এমন সময় ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হবে যখন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ টিকিট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা পুরানো প্রতিষ্ঠানকে বদলে নতুন প্রতিষ্ঠান ‘সহজ’কে কাজ দিয়েছে। সহজের ব্যবস্থাপনায় টিকিট বিক্রির শুরুর দিন থেকেই যাত্রীরা ভোগান্তির মধ্যে। অনলাইনে টিকিট মিলছে না। জানি না এই সমস্যা কত দিনে সমাধান হবে। তবে অগ্রিম টিকিট বিক্রির জন্য আরো বুথ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে উন্মুক্ত এলাকায় অগ্রিম টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করলে মানুষের দুর্ভোগ কমবে।

সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ জেলাসমূহে যাত্রী বিবেচনায় যত বেশি ট্রেন সার্ভিস বাড়ানো যায়, ততই ঘরমুখো মানুষ উপকৃত হবে। ট্রেনের ছাদে যাত্রী পরিবহণ বন্ধ করা দুষ্কর হলেও অতিঝুঁকি নিয়ে যেন কেউ চলাচল না কওে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনের দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা যেন যাত্রীদের মালামাল নিয়ে ওঠানামার ক্ষেত্রে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন, সে রকম নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। টিকিটের কালোবাজারি ঠেকানো তো প্রথম দাবি। যাত্রীদের নিরাপত্তায় স্টেশন ঘিরে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিকেও শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে।

শেষ কথা হলো, সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কম-বেশি ঈদের প্রস্তুতি রয়েছে। রয়েছে পরিকল্পনা। এর মধ্যে নৌ-সড়ক-রেল-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যথাযথ সমন্বয় হলেই নিরাপদ ঈদযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব- এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই পরিকল্পনাগুলো ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’- এমন যেন না হয়। মাঠপর্যায়ে এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। চাই নিরাপদ ঈদযাত্রা। কোনো কারণে উৎসবের যাত্রা যেন বিষাদে রূপ না নেয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

 

মন্তব্য

Beta version