-->

পাকিস্তান: নতুন সরকার কতটা টেকসই হবে

ড. দেলোয়ার হোসেন
ড. দেলোয়ার হোসেন
পাকিস্তান: নতুন সরকার কতটা টেকসই হবে
নতুন প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানকে কতটা এগিয়ে নিতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান পর্যন্ত কেউই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। এর মধ্যে একাধিকবার দায়িত্ব পালনকারী বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফও রয়েছেন। সর্বশেষ ইমরান খানের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুতির মাধ্যমে পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ সব সময় আমরা দেখে আসছি। এমনকি সেখানে অর্ধেকের বেশি সময়জুড়ে সামরিক বাহিনীই ক্ষমতায় ছিল। এর বাইরে ইমরান খানসহ যারাই ক্ষমতায় ছিলেন; সেখানেও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল। ফলে একটা স্থিতিশীল শাসন পাকিস্তানে গড়ে ওঠেনি।

একই সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকদের করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি। সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে কেউ ক্ষমতা হারিয়েছেন, কেউ খুন হয়েছেন। আবার কাউকে দেশছাড়া হতে হয়েছে। সেদিক থেকে বলা চলে, ইমরান খানের সম্মানজনক বিদায় হয়েছে। তিনি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হননি। তিন বছর সাত মাস নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর পার্লামেন্টের ৩৪২ আসনের মধ্যে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ১৭৪টি। তো ইমরান খান বলা চলে, মাত্র ২ ভোটে হেরেছেন। তাকে যারা ক্ষমতাচ্যুত করেছেন, তারাও নির্বাচিত প্রতিনিধি। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেখানে ইমরান খান ত্রিমুখী চাপের মধ্যে পড়েছিলেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণেই যেখানে সামরিক বাহিনী যেমন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে, তেমনি বিচার বিভাগও এ সুযোগ গ্রহণ করে। আর বিরোধীরা তো এমনিতেই ইমরান খানের বিরুদ্ধে সোচ্চার। স্বার্থগত কারণে তারা এক জোট হয়।

ইমরান খান ২০১৮ সালে যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তার পক্ষে সামরিক বাহিনীর সমর্থনের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছর ধরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার একটা দূরত্ব লক্ষণীয় ছিল। সেই সূত্র ধরে এমনকি এর আগেও ইমরান খানের পতনের গুঞ্জন ওঠে। এবারের পতনের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ তিন শক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকাও দেখতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা ইমরান খান সরাসরিই বলেছেন। পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেক আগ থেকেই স্পষ্ট। এমনকি ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হত্যার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে সে সম্পর্কে বড় পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি। আফগানিস্তানের তালেবানদের সহায়তার অভিযোগ নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের তিক্ততার সম্পর্ক প্রকাশ্যে আসে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। তখন ইমরান খান স্পষ্ট করে বলেছেন, আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো সেনাঘাঁটি চায় না পাকিস্তান।

পাশাপাশি চীন, রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার পর পাকিস্তানও অনেকটা সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। ইমরান খান ইউক্রেন সংকটের মধ্যেই রাশিয়া সফর করেন। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর জাতিসংঘে মোট তিনটি ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান ভোটদানে বিরত ছিল। আমরা দেখেছি, মার্চের প্রথম সপ্তাহে ইসলামাবাদে নিযুক্ত পশ্চিমা দূতরা যৌথ বিবৃতি দিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে পাকিস্তানকে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানান। জবাবে ইমরান খান তাদের সমালোচনা করে বলেছিলেন, পাকিস্তান পশ্চিমাদের দাস নয়। এমনকি ইমরান খান ইঙ্গিত দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চেষ্টা করছে। তা ছাড়া শুরু থেকেই ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিরোধী দলগুলোর চেষ্টাকে ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে এর পেছনে মদদ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকাশ্যেই দায়ী করেছিলেন ইমরান খান। এটা স্পষ্ট, এসব বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি। যদিও পাকিস্তানে পশ্চিমা কূটনীতিকদের শক্তিশালী অবস্থানের বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। অন্যদিকে ইমরান খানের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর টানাপড়েন ইউক্রেন সংকটেও স্পষ্ট। ইমরান খান ও সেনাপ্রধান উভয়েই ইউক্রেন বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন। যুদ্ধ প্রসঙ্গে ইমরান খান যেখানে পশ্চিমাদের সমালোচনা করেন, সেখানে পাকিস্তান সেনাপ্রধান রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন। একটি দেশের সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব যখন প্রকাশ্যে দেখা যায়, তার ফল কতটা খারাপ হতে পারেÑ ইমরান খানের পতনই তার প্রমাণ।

পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ : ইমরান খানের পতনের পর বিরোধী জোটের মধ্য থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লীগের (নওয়াজ) সভাপতি শাহবাজ শরিফ। তিনি যদিও অভিজ্ঞ রাজনীতিক, কিন্তু তার হাতে দেড় বছরের মতো সময় আছে। মনে রাখতে হবে, বিরোধী জোট ইমরান খান প্রশ্নে একত্রিত হলেও তাদের মধ্যকার মতাদর্শিক বিরোধও প্রবল। ফলে তারা অবশিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে কিনা, সে সংশয়ও রয়েছে। সেখানে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির মধ্যে যেমন দ্বন্দ্ব রয়েছে, তেমনি তাদের সঙ্গে ইসলামি দলগুলোর দূরত্বও অনেক। শাহবাজ শরিফ পরিবর্তনের কথা বললেও বাস্তবতা কঠিন। পাকিস্তানে হানাহানির রাজনীতি, কায়েমি স্বার্থের প্রভাব এবং সবচেয়ে বড় বিষয় ভঙ্গুর অর্থনীতি। ফলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেটা এখন দেখার বিষয়।

পাকিস্তান বাংলাদেশের প্রতিবেশী হলেও দেশটির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের টানাপড়েনের সম্পর্ক। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি হিসেবে তারা যেভাবে শোষণ করেছে এবং একাত্তরের গণহত্যা, তৎপরবর্তী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়াসহ ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশ পাকিস্তানকে সন্দেহের চোখে দেখে; যদিও ইমরান খান সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর সঙ্গে অবশ্য ইউক্রেন প্রশ্নে জাতিসংঘে ভোটের সম্পর্ক নেই। কারণ জাতিসংঘের তিনটি ভোটের মধ্যে পাকিস্তান তিনটিতেই ভোটদানে বিরত ছিল। যেখানে বাংলাদেশ দুটিতে বিরত ছিল এবং মানবিকতার প্রশ্নে একটিতে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেয়। আমরা দেখেছি, এমনকি ভারতও তিনটিতেই পাকিস্তানের মতো নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে পাকিস্তানের নতুন প্রশাসনে ইমরান খানের মতো আন্তরিকতা হয়তো আমরা দেখব না। তা ছাড়া স্বল্পসময়ের এ প্রশাসন স্বাভাবিকভাবেই অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবে বেশি। নতুন ক্ষমতাসীনদের মতাদর্শিক অবস্থানের দিক থেকেও এটি জটিল প্রশ্ন। বলা বাহুল্য, এমনিতেই বাংলাদেশ বিষয়ে সংবেদনশীল; তার ওপর পাকিস্তানে এখন নতুন ভঙ্গুর সরকার। ফলে তাদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে নিশ্চয় আমাদের সরকার সব দিক বিবেচনা করবে।

পাকিস্তানের বিরোধী জোট যেহেতু সম্মিলিতভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেছে; তাদের আপাতদৃষ্টিও থাকবে কীভাবে আগত নির্বাচনেও তাকে পরাজিত করা যায়। যদিও একদিকে ইমরানের সম্মানজনক বিদায় হয়েছে এবং তার জনপ্রিয়তা এখনো দৃশ্যমান। এমনকি তার ডাকে সাড়া দিয়ে রোববার হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। সর্বশেষ ইমরান খান ও তার দলের এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তিনি সংসদের বাইরে থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এখন সেখানে নতুন প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানকে কতটা এগিয়ে নিতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) সদস্য

মন্তব্য

Beta version