-->
শিরোনাম

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা যে কারণে অমূলক

ড. দেলোয়ার হোসেন
ড. দেলোয়ার হোসেন
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা যে কারণে অমূলক
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শ্রীলংকা কখনও এতটা দুরবস্থায় পড়েনি

শ্রীলঙ্কার সংকটে অনেকেই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা মেলানোর চেষ্টা করছেন। এ চিন্তা নানা কারণে ভিত্তিহীন। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে কিছু দিক থেকে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক থাকলেও কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো নয়। শ্রীলঙ্কা যেমন উন্নয়নপ্রত্যাশী- বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম, রুয়ান্ডাসহ অনেক দেশই উন্নয়নপ্রত্যাশী। এ অঞ্চলের দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার উত্তাপ এখানে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তবে সে পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ থেকে ঋণ গ্রহণকারী দেশ হলো শ্রীলঙ্কা। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের কাছে শ্রীলঙ্কা ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের জন্য অনুরোধ করে। বাংলাদেশ অতীতে ঋণ প্রদান করলেও বর্তমানে অপারগতা প্রকাশ করে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের পেছনের বাস্তবতা আমাদের অজানা নয়। সেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়। আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভে টান পড়ে এবং গত দুই বছরে তার দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। শ্রীলঙ্কার ভেতরকার পণ্যের জোগান ঠিকমতো না থাকায় মূল্যস্ম্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। কর হ্রাস, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি এবং সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়গুলোকে এখন সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটি কখনও এতটা দুরবস্থায় পড়েনি।

শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতাসীন গোটাবায়া রাজাপাকসে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। গোটাবায়া রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সিংহলিদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রায় দশ বছর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং গোটাবায়া ছিলেন তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ অবসানের জন্য তাদের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আমরা রাজাপাকসে পরিবারের প্রভাব দেখেছি। সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হওয়ার কারণ অনেকে যেটা বলছেন, ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া'র মতো। অবকাঠামোতে শ্রীলঙ্কার বিনিয়োগের প্রায় সবটাই বহির্বিশ্ব থেকে ধার করা, যা বাংলাদেশের বিপরীত। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করেছে এবং বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে। গত দেড় দশকে শ্রীলঙ্কা সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, সড়কসহ আরও নানা ধরনের বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেয়। রাজধানী কলম্বোর কাছে শ্রীলঙ্কা দেড় বিলিয়ন ডলারের কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। চীন ওই প্রকল্পে অর্থায়ন করে। এ প্রকল্পগুলো আধুনিক শ্রীলঙ্কার জন্য প্রয়োজন হলেও দেশটির অর্থনৈতিক গভীরতা কম এবং বৈদেশিক অর্থায়নের শর্তগুলো কঠিন থাকায় অনেকটা সাধ্যের বাইরে চলে যায়। সেখানে বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি।

অনেকে বলছেন, এরকম জনতুষ্টিমূলক অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়। যেমন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে কর ও ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করা হয়, তা নিয়ে অনেকেই বিস্মিত হয়েছে। তা ছাড়া করোনা মহামারির বড় প্রভাব দেশটির ওপর পড়ে, যেহেতু শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেকটা পর্যটননির্ভর। করোনাভাইরাস মাহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর্যটন কর্মকা- বন্ধ থাকায় দেশটি চরম সংকটে পড়ে। তা ছাড়া, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশটিতে অদূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, শ্রীলঙ্কার সংকট চরমে ওঠার অন্যতম কারণ দেশটি নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। একদিকে চীন এবং অন্যদিকে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষই শ্রীলঙ্কাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বিপদের সময় তারা কেউই শ্রীলঙ্কার পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়ায়নি। অনেকে আশঙ্কা করেছেন বাংলাদেশের পরিণতি শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। যারা এটা মনে করছেন, তারা স্পষ্টতই ভ্রান্তিতে রয়েছেন। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে দেউলিয়ার পথে থাকা শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে বাংলাদেশ- এমন আশঙ্কা খোদ আমাদের প্রধানমন্ত্রী উড়িয়ে দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনও খেলাপি (ডিফল্টার) হয়নি, হবেও না। দেশের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত, সরকার অত্যন্ত সতর্ক।’ আমরা জানি, একটা দেশ দেউলিয়া হয় যখন সে তার ঋণ শোধ করতে পারে না। অথচ সরকারের হিসাবে, আমাদের যে ঋণ আছে আগামী ৫ থেকে ১০ বছর ধরলেও ঋণ পরিশোধে একটি ‘ইনস্টলমেন্ট’ ব্যর্থ হওয়ারও কোনো আশঙ্কা আমাদের নেই। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দৃঢ়তা ও বাংলাদেশের সক্ষমতার কথা বলেছে, যা বিষয়টিকে আমাদের কাছে আরও পরিস্কার করে তোলে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বড় অর্থনীতির দেশ চারটি- বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে রয়েছে কেবল ভারত। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে যে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা রয়েছে তাদের দুই দেশের জিডিপি যোগ করলেও বাংলাদেশের ডিজিপি তারচেয়ে বড়। এমনকি বাংলাদেশ যে রপ্তানি করে তা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের রপ্তানির চেয়েও বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে আমাদের অবস্থান বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সম্মিলিত রিজার্ভের চেয়ে দ্বিগুণ। তা ছাড়া যেখানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ জিডিপির মাত্র ১২ শতাংশ সেখানে শ্রীলঙ্কার ঋণ জিডিপির প্রায় ৪৮ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু ঋণ ১৬৫০ মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশের ২৯২ মার্কিন ডলার।

সবচেয়ে বড় কথা শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণে সুদের হার যেখানে গড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, সেখানে আমাদের ঋণে সুদের হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশ যেসব প্রকল্পে ঋণ নিয়েছে, সেগুলো দৃশ্যমান এবং সমাজ সেখানে সরাসরি উপকৃত হবে। কৃষি খাতে আমাদের বিস্ময়কর সাফল্য রয়েছে, খাদ্যে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসছে। আমাদের অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রায় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প রপ্তানির প্রধান খাত। তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদের’ যুক্তিটিও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপান, জার্মানি থেকে থাইল্যান্ড, জাকার্তা থেকে থাইল্যান্ড- সব রাষ্ট্রই ঋণ গ্রহণ করে অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে।

পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকেও ভারসাম্য হারায় শ্রীলঙ্কা। আমরা দেখেছি, ২০১০-এর দশকে শ্রীলঙ্কা অনেকটা চীননির্ভর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভারতের প্রভাবও সেখানে বেশ ভালোভাবেই ছিল। কিন্তু তারা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য হারায় শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ এদিক থেকেও সতর্ক। সবার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে সম্পর্ক বজায় রাখার মতো যোগ্য ও দক্ষ কূটনীতি বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রদর্শন করছে। মনে রাখতে হবে, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যা যেখানে দুই কোটির কিছু বেশি সেখানে আমাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। বিদেশের বাজার সংকুচিত হলেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার দিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারব। যদিও বিদেশের বাজার সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা নেই। বরং নানা ক্ষেত্রে বাজার আরও সম্প্রসারণ ঘটছে।

সবদিক থেকেই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন। অযথা দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তবে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি থেকে কিছুটা শিক্ষা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক মহলে অপতৎপরতার বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমাদের ধারাবাহিকভাবে ভালো করার সুযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সরকার সতর্ক রয়েছে এবং জনগণের মধ্যে রয়েছে দৃঢ়তা ও সাহস। আমরা প্রত্যাশা করি, প্রশাসন সম্ভাব্য সব ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) সদস্য

মন্তব্য

Beta version