-->

‘আগামীর বাংলা’ বিনির্মাণে চাই দক্ষ তরুণ প্রজন্ম

সায়েম আহমাদ
সায়েম আহমাদ
‘আগামীর বাংলা’ বিনির্মাণে চাই দক্ষ তরুণ প্রজন্ম

যুগ যুগ ধরে এই পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে তারুণ্যের জয়গান। তাদের সাহস, মনোবল ও উদ্দীপনায় এই পৃথিবীতে আসে পরিবর্তন। অসম্ভবকে সম্ভব করার ঝুঁকি নিতে পারে তারুণ্য। তাদের কাছে অসাধ্য বলতে কিছু নেই। তারুণ্যের জয়গান বা শক্তি নিয়ে বিখ্যাত মনীষীগণ বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন। ফিলিপাইনের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও লেখক জোস রিজালের ভাষায়, ‘তারুণ্যই হলো আমাদের ভবিষ্যতের একমাত্র আশা।’ কথাটি চরম সত্য। কারণ, প্রতিটি দেশের জন্য তারুণ্য বা তরুণ প্রজন্ম বড় সম্পদ। তারাই পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালনা করবে, দেশের জন্য কাজ করবে। তেমনিভাবে আমাদের দেশের আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামীর বাংলাদেশ গড়ার কারিগর। তাদেরকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি, বিশ্ব দরবারে এই সোনার বাংলাকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে গড়ে তুলবে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন কারী বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত বাংলাদেশ’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে একটি উদ্ভাবনী দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হতে চাচ্ছে। কাজেই তরুণ প্রজন্মেকে নিয়ে ভাববার বিষয় বা আলোচনা করার সময় এসেছে।

বর্তমান তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্র সম্পর্কে কী চিন্তা-ভাবনা করছে? কিংবা ভবিষ্যত নিয়েই-বা তাদের চিন্তা ভাবনা কী? এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা জরুরি। এই প্রেক্ষাপটে অতীতের কিছু কথা বলতে হবে। আগেরকার সময়ে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের যখন শিক্ষক কিংবা কেউ প্রশ্ন করতো যে, তোমরা ভবিষ্যতে কী হতে চাও? তারা নির্দ্বিধায় উত্তর দিত, ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব, শিল্পপতি হব, শিক্ষক কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট হব। কেউ কেউ সাহস করে বলে ফেলতো যে আমি ‘পাইলট হব, প্লেন চালাব। কিন্তু কেউ সাহস করে এটা বলে না যে, আমি একদিন বড় রাজনীতিবিদ হব, দেশের প্রধানমন্ত্রী হব, দেশের যেকোন মন্ত্রী পদের দায়িত্ব পালন করব। তরুণ প্রজন্ম এমন ইচ্ছে বা স্বপ্ন কেন দেখে না? কেন তাদের এমন বড় স্বপ্ন দেখা নিয়ে অনীহা? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। অথচ বিশ্বখ্যাত জার্মান কবি ও দার্শনিক জোহান গথে বলেছেন, ‘স্বপ্ন দেখলে বড় করে দেখো। সেটাই তোমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করবে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগাবে।’ কিন্তু এমন বড় স্বপ্ন কয়জনে দেখেন তা বলা দুষ্কর। এই দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য পরিতাপের বিষয় হলো, এখনকার ছেলে-মেয়েদের প্রশ্ন করলে তাদের শতকরা অর্ধেকেরও বেশি যে উত্তর দেয় তা হলো দেশের বাইরে ভবিষ্যত জীবন গড়ে তোলার। এখন প্রশ্ন জাগে, বিদেশে গেলে কি আগামীর বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে? কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য যাওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে নিজের মেধার ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। তরুণ প্রজন্ম যদি এমন লক্ষ্য উদ্দেশ্যে নিয়ে বিদেশে যায় তাহলে দোষের কিছু নয়।

আজকাল তরুণ প্রজন্ম সৃজনশীল চর্চায় অনীহা প্রকাশ করেছে। দিনদিন বই বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারে না। অথচ তারা ইচ্ছা করলে যেকোনো সৃজনশীল চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারে। কিন্তু তারা সেটি না করে ঘন্টার পর ঘন্টা বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় অপচয় করছে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই ইন্টারনেট জগতে চলে যাচ্ছে, ফেইসবুক স্ক্রলিং করছে, ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখছে। অথচ তার উচিত- যার যার ধর্মীয় নীতি পালন করে দৈনন্দিন রুটিন মাফিক চলাফেরা করা।

বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারণে তরুণদের যাত্রা খুব সহজ হবে না, যদি না তারা সঠিকভাবে নিজেদের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ইচ্ছা, সম্ভাবনা ও সীমিত সম্পদের সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যম তৈরি করে। এই তরুণদের সামনেই আজ সফল উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের উন্নয়ন এবং বিশ্বের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো দূর করার সুযোগ রয়েছে। সুযোগ আছে দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে বিভিন্ন জাতীয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নেতৃত্ব দেওয়ার। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে এবং পাচ্ছে। আর এই সুযোগ কিন্তু শুধু বাংলাদেশের তরুণদের জন্যই প্রযোজ্য নয়। বরং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সব তরুণই এই সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে ও করবে। আমাদের তরুণেরা ও যুবসমাজ কি ভবিষ্যতের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হচ্ছে? যদি তারা তৈরি না হয়, তাহলে এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিশ্বায়নই কিন্তু জীবনের পথ চলায় চাকরি হারানো, হতাশাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। আর সেজন্যই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য এখনই গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য তরুণদের নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক মহলকে ভাবতে হবে এবং তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে।

জনসংখ্যার বিবেচনায় বৃহৎ অংশ তরুণ। দেশে প্রায় ৪ কোটি ২০ লক্ষ তরুণ। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে গেলে এই বিশাল তরুণ প্রজন্মকে উন্নয়ন কর্মে নিয়োজিত করতেই হবে। নয়তো কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জিত হবে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের নিয়ে আলাদাভাবে সুস্পষ্ট কথা উল্লেখ করতে হবে। ভবিষ্যতে তাঁরা কী ধরণের কর্মে নিয়োজিত হবেন, তরুণদের জন্য কী সুযোগ আছে এবং দলগুলো কী ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করবে, এসব বিষয় গুলো ইশতাহারে সুস্পষ্ট উল্লেখ ও বিবরণ থাকা দরকার। তরুণদের মাঝে দেশপ্রেম ও দেশের উন্নয়ন চিন্তা ভাবনা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে সততা, নৈতিকতা এবং নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করার পাশাপাশি বিভিন্ন দলের গঠনমূলক সমালোচনা করার মত মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কারণ, তাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ একদিন রাজনীতিবিদ হবে। যদি এর বিপরীত হয় তাহলে দেশের রাজনীতি, দেশের উন্নয়ন, নিজের উন্নয়ন থেকে তরুণ প্রজন্ম ছিটকে পড়বে।

সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠনে তরুণদেরকে নিয়ে এগোতে হবে। তরুণদের একতার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাজ গঠন করা সম্ভব। তারা সমাজ ব্যবস্থায় ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ, দুর্নীতি সহ বিভিন্ন অরাজগতা বা বিশৃঙ্খলা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের দেশে অধিকাংশ তরুণ স্বেচ্ছাসেবী হয়ে অসহায় মানুষদের হয়ে কাজ করছে। তাদের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারি ও এনজিও ভিত্তিক সংগঠন গুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের মানুষের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন গড়ে উঠেছে এবং নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। সেজন্য তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। মোটকথা, আগামীর বাংলাদেশ গড়তে তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য এখনই গড়ে তুলতে হবে। তাদের গড়ে তোলার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে তারুণ্যের জয়গানে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

মন্তব্য

Beta version