-->
শিরোনাম

দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা : দায় কার?

মাহবুব আলম
মাহবুব আলম
দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা : দায় কার?
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এমন যে প্রাণ রক্ষার জন্য জরুরি ওষুধ ও খাদ্য কিনবে তারও সামর্থ্য নেই সরকারের

শ্রীলঙ্কায় এখন এক কাপ চায়ের দাম ১০০ রুপি, আর এক কেজি চালের দাম ৫০০ রুপি। শুধু চাল, চা নয়, অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্যপণের মূল্যও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। অবস্থা এখন এমন যে, কোনো ব্যক্তি বা পরিবার একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছে। শ্রীলঙ্কায় আর্থিক বিপর্যয়ের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশটির এই অবস্থা হয়েছে। দেশটির অবস্থা যে কত খারাপ তার একটা ছোট চিত্র তুলে ধরলেই বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে।নিউজপেপার ও কালির সংকটে দেশের সব সংবাদপত্রের ছাপা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। লেখার কাগজ সংকটে স্কুল-কলেজের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কাগজ নেই, কালি নেই। কারণ কাগজ ও কালি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। অর্থ নেই জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কার সর্বত্র মাত্র ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে। বাকি ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ। বিদ্যুৎ সংকটে রাস্তার ল্যামপোস্ট স্ট্রিম লাইটও জ্বলে না। নেই রান্নার গ্যাসও। বাধ্য হয়ে লঙ্কানরা এখন কেরোসিন, কাঠ ও কয়লা ব্যবহার করছে। তাও সহজ প্রাপ্য নয়। কেরোসিনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। পেট্রোল-ডিজেলের জন্যও একই অবস্থা। বাধ্য হয়ে সরকার পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনা মোতায়েন করেছে। ডিজেল-পেট্রোল সংকটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গণ পরিবহণ। বিদ্যুৎ সংকটে হাসপাতালগুলোতে সার্জারি হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বন্ধের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর চালিয়ে হাসপাতালে জরুরি সার্জারি করবে তারও উপায় নেই। কারণ জেনারেটর চালানোর জন্য যে ডিজেল প্রয়োজন তাও মিলছে না বাজারে।

বিভিন্ন খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের মতো পেট্রোল-ডিজেল রান্নার গ্যাস উধাও হয়ে গেছে। যা আছে তা কালোবাজারি ও মজুতদারদের কবলে। এমনকি প্রাণরক্ষাকারী জরুরি ওষুধও মিলছে না। ফলে শ্রীলঙ্কার হাসপাতালগুলোতে সব মেডিকেল টেস্ট বন্ধ হয়ে গেছে। এক কাথায় খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিছু মিলছে না মাহেন্দ্র রাজাপাকসের শ্রীলঙ্কায়। এ বিষয়ে শ্রীলঙ্কার একজন শিক্ষক বলেছেন, আর্থিক বিপর্যয়ের আগে তার ৪ সদস্যের পরিবারের বাজার খরচ ছিল মাসে ৩০ হাজার রুপি। বিপর্যয়ের পর গত এক মাসে তার সেই বাজার খরচ দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার রুপি।

আর্থিক সংকটে শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্য পড়ে গেছে। এক মাস আগে এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাওয়া যেত ১৭৮ টাকা। এখন এক ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩০০। রাতারাতি কোনো দেশের মুদ্রার এমন মূল্য হ্রাস এক নজীরবিহীন ঘটনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো শ্রীলঙ্কায় এমনটাই ঘটেছে। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এমন যে প্রাণ রক্ষার জন্য জরুরি ওষুধ ও খাদ্য কিনবে তারও সামর্থ্য নেই সরকারের। ১৫ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, তাদের হাতে রয়েছে মাত্র ২৩০ কোটি ডলার রিজার্ভ। এই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে তারা প্রয়োজনীয় খাদ্য জ্বালানি কিনবে না ঋণের সুদ আসল শোধ করবে? না, কোনোটাই করতে পারবে না। তাই তো বাধ্য হয়ে শ্রীলঙ্কার সরকার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে এবং তেল আমদানির জন্য ভারত, চীন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছে। সাহায্যের আবেদন করেছে প্রবাসী লংকানদের প্রতিও। বলেছে এই সংকটের পাশে দাঁড়ান, সরকারকে অনুদান দিন। অর্থাৎ প্রবাসীদের প্রতি নগদ অর্থ প্রেরণের আহ্বান জানিয়েছে। কী অসহায় অবস্থা সরকারের। এ যেন রাষ্ট্রের পতন। অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এটা হলো কী করে? আর এর জন্য কে বা কারা দায়ী? বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। শ্রীলঙ্কা এমনিতে কোনো গরিব দেশ নয়। গরিব দেশ নয়- এ জন্য বলছি, কারণ শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু আয় ৩৮৩০ মার্কিন ডলার, যা আমাদের বাংলাদেশে ও ভারতের চাইতে অনেক বেশি। তারপর এই বিপর্যয় কেন? শুধু বিপর্যয় বললেই যথেষ্ট নয়। কারণ দেশটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। একথা তাদের সরকার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছে। আর তাই তো ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ধরনা দিচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও ধনাট্য ব্যক্তির এবং তার নিজ দেশের প্রবাসী নাগরিকদের কাছে।এ আর্থিক বিপর্যয় দেউলিয়াত্বের জন্য শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন গোটাবায়া রাজাপাকসের সরকার বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, করোনা মহামারির ক্ষয়ক্ষতি ও ইউক্রেন সংকটের কারণে জ্বালানি তেল ও বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করেছে। সরকার ও রাষ্ট্রপধান গোটাবায়া রাজাপাকসে এ জন্য তার সরকারের গৃহীত নীতি ও কর্মপন্থার দুর্বলতা ও ব্যর্থতার কথা বলেননি। এটাই তৃতীয় বিশ্বের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের চরিত্র। তারা কখনোই নিজেদের ব্যর্থতা দেখতে পান না। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই পরিস্থিতির জন্য মূলত সরকারের তুগলকি কাজই দায়ী।

বিষয়টা একটু স্পষ্ট করে বলা যাক। ২০১৯ সালে গোটাবায়া রাজপাকসের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কায় নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়। ক্ষমতাসীন হয়ে গোটাবায়া সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুয়ায়ী ট্যাক্স কমানো শুরু করে। জনগণের ওপর থেকে করের বোঝা কমিয়ে ১৮ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ করে। এ ছাড়া ব্যাংকিং লেনদেনসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স পুরোপুরি উঠিয়ে দেয়। আগের সরকারের আমলে ৪ লাখ রুপি আয় হলেই আয়কর দিতে হতো। সেই আয়করের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে ৩০ লাখ করা হয়। অর্থাৎ ৩০ লাখ টাকার নিচে আয় করলে কাউকে আয় কর দিতে হয় না। ফলে রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে ফ্লপ খায়। অন্যদিকে এই সময় করোনা মহামারির আঘাতে শিল্প-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। গার্মেন্ট, চা রপ্তাানি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এই সময় প্রবাসী আয় অর্থাৎ রেমিট্যান্স হ্রাস পায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার টান পড়ে। রপ্তানি হ্রাস ও আমদানি বৃদ্ধির ফলে একপর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট পড়ে। এছাড়া শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত পর্যটন মুখ থুবড়ে পড়ে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি নড়বড়ে অবস্থায় ছিল। ২০ বছরের গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয় তা থেকে বেরিয়ে আসতে একটা স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি দেশটি। তার ওপর ছিল ঋণের বোঝা। তারপরও সরকার চড়া সুদে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে ঋণ নিয়ে দেশ পরিচালনা করে। চড়া সুদে সার্বভৌম রাষ্টের ঋণ ও সুদ মিলিয়ে সরকারকে শোধ করতে হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য আড়াই বিলিয়ন ডলার শোধ করেছে। বাকি অর্থ শোধ করার কোনো ক্ষমতা নেই সরকারের। কারণ শ্রীলঙ্কার কাছে আছে মাত্র ২৩০ কোটি ডলার। এই সংকটজনক অবস্থা আঁচ করে গোটাবায়া সরকার বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে সার আমদানি বন্ধ করে। দেশে অর্গানিক চাষের প্রচলনের ডাক দেয়। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়া এই অর্গানিক ফার্মিং শ্রীলঙ্কার জন্য বড় কাল হয়েছে। কারণ এর ফলে খাদ্য উৎপাদন ন্যূনতম ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। দেশে চায়ের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অথবা চাল কেনার ক্ষমতা নেই। সবকিছু মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার এখন মহা বিপদ।

পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতি:

জনগণের ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজপাকসে ও তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দ্র রাজাপাকসে ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিবারতন্ত্রকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে তা রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে এক ভাই প্রেসিডেন্ট আরেক ভাই প্রধানমন্ত্রী শুধু নয়, মন্ত্রিসভায় তার আরো ভাই-ভাতিজা ও ভাইঝিরা রয়েছেন। এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া পার্লামেন্টে এই রাজাপাকসে পরিবারের ৭-৮ জন সদস্য রয়েছেন। আছেন প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে কর্মকর্তা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রের বাজেটের ৬০ থেকে ৭০% ব্যয় হয়ে থাকে রাজাপাকসের পরিবারের মাধ্যমে। ফলে আার্থিক সংকটে শ্রীলঙ্কা বিপর্যয়ের শেষ সীমনায় পৌঁছে দেউলিয়া হলেও রাজাপাকসে পরিবারের কারোর অর্থ সম্পদে কোনো ঘাটতি পড়েনি। দেশের চরম অর্থনৈতিক সংকটের মাঝে তাদের পরিবারের অর্থ সম্পদ ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ নয় বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। তাই তো কপর্দক শূন্য পিতার সন্তান গোটাবায়া ও মাহেন্দ্র রাজাপাকসেসহ তার পরিবার এখন শ্রীলঙ্কার সম্পদশালী পরিবারে পরিণত হয়েছে। শুধু সম্পদশালীই নয়, প্রভাবশালী পরিবারও বলে। তাই তো প্যান্ডোরা পেপার্সে মাহেন্দ্র রাজাপাকসে, গোটাবায়া রাজাপাকসে, নিরুপমা রাজাপাকসে ও থিরুকু মারনের বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। প্যান্ডোরা পেপারসে উঠে এসেছে তাদের বিদেশে অননুমোদিত বিনিয়োগের বিষয়টিও। এছাড়া নিজ দেশে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় অংশীদার এই রাজাপাকসে পরিবার। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য সরকারের অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শিতাই শুধু নয়, এর জন্য দায়ী চুরি, দুর্নীতি, অপচয় ও স্বেচ্ছাচারিতা। এ ছাড়া আরো একটি কারণ হলো, মুসলিমবিদ্বেষ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা।

দীর্ঘ দিন ধরে শ্রীলঙ্কায় তামিল হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক শুরু হয় মুসলিম বিদ্বেষ। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হচ্ছে। আর দাঙ্গা মানেই ক্ষয়ক্ষতি-অগ্নিসংযোগ। সেই সঙ্গে দখল। আর তাই তো শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকারকে প্রবাসী লঙ্কানরা আস্থায় নিতে পারছে না। সরকারকে তারা বিশ্বাস করছে না। সরকারের অর্থ প্রেরণের আহ্বানে ভাটা পড়েছে। তারা বলছে, আমাদের প্রেরিত অর্থ অসহায় মানুষদের কাছে যাবে তার কি গ্যারান্টি আছে? এ প্রসঙ্গে তারা ২০০৪ সালের সুনামি তহবিরের প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, ওই সময় সরকার সুনামি তহবিলের অর্থ যাচ্ছেতাইভাবে খরচ করেছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

মন্তব্য

Beta version