-->

মাহে রমজানের ফজিলত

ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আব্দুল্লাহ
মাহে রমজানের ফজিলত

আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং পরকালীন শান্তির কথা ভেবে নিজের কৃত গুণাহের ব্যাপারে অনুশোচনা করা উচিত। এ অনুশোচনা করে কৃত গুণাহ ভবিষ্যতে আর কখনো না করার অঙ্গীকার করে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। যদি আল্লাহ কাউকে গুণাহের ব্যাপারে এমন অনুতাপ করার সৌভাগ্য দান করেন, তবে দৃঢ় বিশ^াস রাখতে হবে যে, এ তওবার ফলে গুণাহের সমূহ প্রভাব একেবারেই মুছে গেছে এবং আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে গেছে। সূরা তহরীমে উল্লেখ আছে যে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহর কাছে প্রকৃত তওবা কর। আশা করা যায় যে, তোমাদের প্রতিপালক (তওবার পর) তোমাদের গুণাহসমূহ মাফ করে দেবেন আর তোমাদেরকে বেহেশতের ওইসব বাগ-বাগিচায় প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হবে।’

ইসলাম ধর্মের ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভ; যথা- ঈমান, নামাজ, যাকাত, রোজা ও হজ এবং পবিত্র কোরআনের দিক-নির্দেশনা। পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে চতুর্থ হচ্ছে রোজা। ইসলামের পূর্ণ রমজান মাসের রোজা ফরজ। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারাহর রুকু ২৩-এ রোজা সম্পর্কে নি¤েœাক্তভাবে উল্লেখ আছে:হে মোমেনগণ, তোমাদের প্রতি রোজার আদেশ দেয়া হচ্ছে (ফরজ করা হলো) যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতিও আদেশ হয়েছিল যে, তোমরা পরহেজগার হবে। রোজা কয়েকটি নির্দিষ্টসংখ্যক দিনের জন্য নির্ধারিত। তবে তোমাদের মধ্যে যে পীড়িত বা প্রবাসে থাকে, তার জন্য অন্য সময়ে ওই সংখ্যক দিন, আর যে ব্যক্তির রোজা রাখা দুঃসাধ্য তার বদলে দরিদ্র ভোজন করাবে। আয়াত (১৮৩-১৮৪) রমজান এমন মাস যাতে কোরআন নাজিল হয়েছে, এটি লোকের প্রতি পথ-প্রদর্শক, সুপথের নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যা ঠিক করার ব্যাখ্যাদাতা। সুতরাং যে কেহ এ মাসে উপস্থিত থাকে, সে যেন এতে রোজা রাখে, আর যে পীড়িত হয় কিংবা সফরে থাকে, সে যেন অন্য সময় ওই ক’দিন রোজা রাখে। আয়াত (১৮৫) ‘রোজার রাত্রিতে তোমাদের জন্য আপন স্ত্রী সহবাস হালাল করা হলো, তারাতোমাদের পোশাক এবং তোমরাও তাদের পোশাক স্বরূপ।... আর আহার পানি খাও যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখা থেকে প্রভাতে সাদা রেখা দেখা যায়, তারপর রাত্রি পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর। আর যখন তোমরা মসজিদে এহতেকাফ করতে যাও, তখন তাদের সাথে সহবাস করো না। এটা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা, অতএব তাদের নিকটেও যেও না।’ আয়াত (১৮৭)

উপরে বর্ণিত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছে এবং রোজা রাখার নিয়ম-কানুন বিধৃত হয়। আয়াত থেকে বোঝা যায়, আগেকার উম্মতগণের রোজা সমগ্র শর্ত ও প্রকৃতির দিক দিয়ে মুসলমানদের ওপর ফরজকৃত রোজারই অনুরূপ ছিল। হযরত মুসা ও ঈসা (আঃ) সহ পৃথিবীর আদিকাল থেকেই রোজার প্রচলন দেখা যায়। তবে রোজার সময়সীমা, সংখ্যা এবং কখন রোজা রাখা হবে, এসব ব্যাপারে আগেকার উম্মতদের রোজার সাথে মুসলমানদের রোজার পার্থক্য রয়েছে। ইসলামে পূর্ণ রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে এবং রোজার সময় সূর্য উঠার আগ মুহূর্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো পানাহার করা যাবে না। তাছাড়া রমজান মাসের পুরাটাই (চন্দ্র মাস হিসাবে কোনো সময় ২৯টা আবার কোনো সময় ৩০টা) রোজা রাখার বিধান করা হয়েছে।

রোজার মধ্যে যেহেতু খাওয়া-দাওয়া ও কাম প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করা থেকে নিজ মনকে এবাদতের উদ্দেশ্যে বাধা দেয়া হয়, একমাত্র আল্লাহ্ তা’লার উদ্দেশ্যে নিজের প্রবৃত্তিতে চাহিদাকে বিসর্জন দেয়া হয় সেহেতু আল্লাহ্ তা’লাও এর সওয়াব ও পুরস্কার সবচেয়ে বেশি নির্ধারণ করেছেন। রোজার প্রতিদান আল্লাহ্ স্বয়ং নিজ হাতে বান্দাকে প্রদান করবেন। পূর্ণ ঈমান, বিশ^াস, একাগ্রতা ও আল্লাহকে খুশি করার জন্য যে ব্যক্তি রোজা রাখেন তার পূর্ববর্তী গুণাহসমূহ (কবীরা গুনাহ ব্যতীত) ক্ষমা করে দেবেন। রোজা মুসলমানদের জন্য দোযখের ঢালস্বরূপ এবং তা একটি মজবুত কেল্লা যা রোজাদারদের দোযখের আগুন থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদে রাখবে। রোজা রেখে একমাত্র আল্লাহর জন্য তার খাওয়া-দাওয়া ও নফসের খায়েশ বিসর্জন দেয়া হয় এতে আল্লাহ্ সে বান্দার ইহকাল ও পরকাল সুখময় করে দেন। রোজাদার ব্যক্তি অবশ্যই কম কথা বলবেন (কারণ বেশি কথা/অহেতুক কথা বল্লে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হতে পারে), গোলমাল পরিহার করবেন, অসৎ কাজ ও অসৎ চিন্তা করবেন না, আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকবেন তবেই আত্মার পবিত্রতা এবং তাকওয়া ও পরহেজগারীর গুণ অর্জিত হবে।

রোজা দ্বারা মানুষের মাঝে তাকওয়া ও পরহেজগারি সৃষ্টি হয়। মানুষ সৎ পথে চলার অনুপ্রেরণা লাভ করেন। নিজের প্রবৃত্তির অবাধ্য নেশার দড়ি নিজ হাতে নেয়ার শক্তি ও যোগ্যতা অর্জন করে। আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে নিজের প্রবৃত্তিগত চাহিদা দমন করার অভ্যাস নিজের মধ্যে গড়ে ওঠে। নিয়মিত সময়ানুসরণে নামাজ আদায়, পবিত্র কোরআন পাঠ, জিকির (ধ্যান), অসৎ কাজ পরিহারসহ রোজার অন্যান্য নিয়মাবলি পালন করে নিজ আত্মার এক অলৌকিক প্রশিক্ষণ ও উন্নতি সাধন করা যায় যা একজন মানুষকে পশুত্বের গ-ি থেকে বের করে এনে মানুষের কাতারে দাঁড় করে দেয়। মিথ্যা কথন, পরনিন্দা, গালিগালাজ পরিহার করে জিহ্বাকে সংযত করতে হবে, আজে বাজে জিনিস দেখা (সিনেমা, বেপর্দা মহিলা, নগ্ন ছবি ইত্যাদি) থেকে চোখকে হেফাজত রাখতে হবে এবং মনকে কুচিন্তা বাদ দিয়ে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতে হবে। এভাবে পরিপূর্ণ রোজা রাখতে পারলে আল্লাহ নিজ হাতে যা যা (পুরস্কার) দিবেন। রোজা সম্পর্কে অনেক হাদিস আছে তবে যেগুলো পবিত্র কোরআনের সাথে সামঞ্জস্য ও সহি সেগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।

যে ব্যক্তি রোজা রেখেও বাজে কথাবর্তা এবং অসৎ কাজ ত্যাগ করে না তবে তার খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। এমন কিছু ব্যক্তি রোজা রাখে অথচ রোজা রেখে বাজে কথাবার্তা ও বাজে কাজকর্ম ত্যাগ করে না, তার এজন্য তাদের রোজার অর্জন ক্ষুধা-পিপাসা ছাড়া আর কিছুই হয় না। রোজা রেখে খাওয়া দাওয়া ছাড়া সব ছোট-বড় গুণাহ থেকে বেঁচে থাকবে। মিথ্যা বলবে না, পরিনিন্দা (গীবত) করবে না, গালিগালাজ ও ঝগড়ায় লিপ্ত হবে না অর্থাৎ রোজা থাকাকালে সব বাহ্যিক ও আত্মিক গুণাহ থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকবে। কাজেই পূর্ণ ঈমান বিশ^াসের সাথে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং তাঁর থেকে সওয়াব অর্জন করার নিমিত্তে রমজান মাসে রোজা রাখলে তার পূর্ববর্তী গুণাহ মাফ পাওয়া যাবে। বিনা কারণে রমজান মাসের রোজা বাদ দেয়া ঠিক হবে না এবং এটি ভীষণ গুণাহর কাজ। কাফফারা দ্বারা রোজা ভাঙ্গার গুণাহ ক্ষমা হলেও রমজানের রোজার সওয়াব ও মর্যাদা লাভ করা সম্ভব না। কাজেই আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান এনে রমজান মাসে সহিভাবে রোজা পালন করা সব মুসলমানের উচিত যেহেতু রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে; সেহেতু এ ফরজ আদায় করা অবশ্যই সবার কর্তব্য। যারা আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে না, আল্লাহর কর্তৃক প্রেরিত কেতাব বিশ^াস ও মান্য করে না, রসূল (সা.) রসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না তারা অবশ্যই খোদাদ্রোহী ও পাপি যা ক্ষমার অযোগ্য। যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে তাঁর কিতাব ও রসূল (সা:) কে বিশ্বাস করে এবং সে পথে চলার অঙ্গীকার করে তারাও শয়তানের ধোঁকায় বা প্রবৃত্তির তাড়নায় পড়ে গুণাহে/পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যায়, এমন সব লোকদের জন্য আল্লাহ্ তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনার দরজা খুলে রেখেছেন। যখন কোনো বান্দা কোনো নাফরমানি/পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আয়াতানুসরণ করে না অর্থাৎ গুণাহর কাজ করে ফেলে, পরে তার ভেতরে অনুশোচনা সৃষ্টি হয় এবং ভবিষ্যতে এমন গুণাহ না করার ব্যাপারে সংকল্প করে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চায়, সেটাই তওবা। তওবা করলে আল্লাহ্ তওবা কবুল করে ক্ষমা করে দেন।

আল্লাহর দয়াময় সত্তায় আমরা উৎসর্গিত। তিনি আমাদের মতো গুণাহগারদের জন্য তওবার দরজা খোলা রেখে আমাদের মুক্তির পথ সুগম করে রেখেছেন, নচেৎ আমাদের ঠিকানা যে কোথায় হতো তা কল্পনা করা যায় না। আল্লাহ্ নিজেই পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদাহ এ বলেন, ‘তারা কেন আল্লাহ্র কাছে তওবা করে না আর কেন ক্ষমা প্রার্থনা করে না, অথচ আল্লাহ্ তওবা কবুলকারী ও ক্ষমাশীল। আল্লাহ্ চান না আমরা গুণাহ করি এবং এগুলোর জন্য খাস দিলে তওবা না করলে পরকালে মহাশাস্তি অপেক্ষা করছে। বারবার একই ধরনের গুণাহ করে বারবার আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিতে পারেন কিন্তু তিনি মর্মাহত হন। কাজেই একই গুণাহ বারবার করে ক্ষমা না চেয়ে সে গুণাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আমরা গুণাহ করতে থাকব আর তওবা করতে থাকব সেটা মুমিনের কাজ নয়।

আমরা গুণাহ করে তওবা করি না এবং মনে করি এখন আমরা যুবক, বুড়ো হয়ে যাওয়ার পর মৃত্যুর আগে কোনো এক সময় সব গুনাহের জন্য তওবা করে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাইব। এটি আমাদের প্রতি শয়তানের একটা বড় ধোঁকা। সে যেভাবে স্বয়ং আল্লাহ্র রহমত থেকে দূর হয়ে চির জাহান্নামি হয়ে গেছে তার মধ্যে আমাদেরকেও তার সাথী বানাতে চায়। আমরা কেউই জানি না যে, আমাদের মৃত্যু কখন আসবে। এক্ষেত্রে আমরা প্রতিদিনকে জীবনের শেষ দিন মনে করে যখনই গুণাহ করছি সাথে সাথে তওবা করে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাই। তাই আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনের সূরা নিসায় বলেন যে, ‘শুধু ওইসব লোকদের তওবা কবুল করা আল্লাহ্র জিম্বায় রয়েছে, যারা অজান্তে গুণাহ করে ফেলে আর যথাশীঘ্র তওবা করে নেয়। আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং তাদের তওবা কবুল করে নেন। আর আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। আর ওইসব লোকের তওবা তো তওবাই না, যারা অহরহ গুণাহর কাজ করে যেতে থাকে, এমনকি যখন মৃত্যু তাদের একদম সামনে এসে দাঁড়ায় তখন সে বলে যে, এখন আমি তওবা করছি (এদের তওবা গ্রহণযোগ্য নয়)। আর যারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাদের তওবাও কবুল করা হবে না। এসব লোকদের জন্য আমি ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি।’ আসুন মাহে রমজানে আমরা নিজ নিজ গুণাহর জন্য তওবা করি।

লেখক: গবেষক, পরামর্শক ও ইসলামী চিন্তাবিদ

মন্তব্য

Beta version