শব্দ ও বায়ুদূষণে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। বিশেষ করে, শব্দ ও বায়ুদূষণে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষের বেহাল অবস্থা। ভয়াবহ শব্দ ও বায়ুদূষণের কবলে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। প্রতি বছরই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, শব্দ ও বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করে। বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বায়ুর গুণাগুণ পরীক্ষা করে এসব গবেষণা ওঠে আসছে, ঢাকার বায়ু সবচেয়ে বেশি দূষিত। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় বায়ুর সাথে মিশ্রিত বিভিন্ন দূষিত পদার্থ ফুসফুসে গিয়ে নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করে থাকে। পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় শব্দ ও বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। শব্দ ও বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ঢাকায় বছরে হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকে।
রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটার জায়গায় এসপিএম মিশে ২০০ মাইক্রোগ্রাম। এটা জাতীয় মানদণ্ডের চেয়ে দ্বিগুণ এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। অপরদিকে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসে ২৪ ঘণ্টায় ১০০ কেজি সিসা, তিন হাজার ৫০০ কেজি এসপিএম, এক হাজার ৫০০ কেজি সালফার-ডাই অক্সাইড, ১৪ টন হাইড্রোজেন ক্লোরাইড ও ৬০ টন কার্বন মনোক্সাইড মিশে। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি করে যাচ্ছে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ ঢাকার বাতাসে মিশছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি, কলকারাখানা, ইটের ভাটায় ইট পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং হাসপাতালের অনিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে। এমনকি ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মিশে যাচ্ছে অনিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশনের কারণেও। যানবাহনের মধ্যে পরিবেশ দূষণ করে থাকে ট্রাক, কয়েক প্রকারের বাস, ডিজেলচালিত অন্যান্য যানবাহন এবং টু-স্ট্রোকের মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য বাহন।
ঢাকায় মোট শব্দদূষণের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ দায়ী পরিবহণ। পরিবহণে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে হাইকোর্টের বিধিনিষেধ থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। বিষয়গুলো যাদের দেখার কথা তারা যথাযথভাবে তা দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে শব্দদূষণ নিয়ে আমাদের এত চিন্তা করতে হতো না। জনসচেতনতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। শব্দদূষণ রোধে সরকার কাজ করছে। সরকারের পাশাপাশি দেশের সচেতন লোকজনদেরকেও বায়ু ও শব্দদূষণের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে
বায়ুদূষণের ফলে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগ, অ্যাজমা (হাঁপানি), বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া এবং আইকিউ হ্রাস পাওয়ার মতো নানা ধরনের অসুস্থতায় ভুগছে। শুধু কলকারখানা ও যানবাহন নয়, অনিরাপদ হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। হাসপাতালে ব্যবহৃত সুই ও রক্ত ব্যবহার করে রক্তসহ ব্যাগ, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, গজ-ব্যান্ডেজ, মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ইত্যাদি উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য থেকে পরিবেশে রাসায়নিক পদার্থ মিশে পরিবেশ দূষণ করছে। ঢাকার আকাশে প্রতিদিন মিশে যাচ্ছে প্রচুর অ্যামোনিয়া গ্যাস। এই অ্যামোনিয়া মিশছে খোলা আকাশের নিচে ত্যাগ করা মল-মূত্র থেকে। ফুসফুসের রোগসহ নানা ধরনের রোগের জন্য দায়ী অ্যামোনিয়া গ্যাস। তাছাড়া মল-মূত্র ও সার থেকে বায়ুবাহী ক্ষতিকর কণা তৈরি হচ্ছে এবং তা ফুসফুসে গিয়ে ক্ষতি করছে।
বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সের প্রতিবেদন মতে, বায়ুদূষণের দিক থেকে ঢাকা বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। গ্লোবাল এনভায়রন ইনডেক্স অনুসারে, রাজধানীতে কার্বন রয়েছে গ্রহণযোগ্য ২৯০-৩০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) মাত্রার চেয়ে ৫০ বেশি। অর্থাৎ ঢাকায় কার্বনের পরিমাণ ৩৫০ পিপিএম। এসব পিপিএম আসছে ঢাকার কাছের ইটভাটা থেকে ও পুরোনো গাড়ির ধোঁয়া থেকে। এসব গাড়ি জ্বালানি পুরোপুরি পোড়াতে পারে না, পার্টিকল আকারে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া পিপিএম আসছে শিল্প-কারখানার ধোঁয়া ও বিষাক্ত পদার্থ বাতাসে ছেড়ে দেয়ার কারণে এবং রাস্তা সংস্কারের ফলে নির্গত ধোঁয়া ও অন্যান্য উপায়ে।বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ধুলাবালি, কলকারাখানা, যানবাহন ও হাসপাতাল বর্জ্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশ বায়ুদূষণ হ্রাসে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বাংলাদেশে তা শুধু কথামালা ও কাগজেই সীমাবদ্ধ। বায়ুদূষণ রোধে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে না পারলে রাজধানীবাসী তথা পুরো দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতেই থাকবে। বায়ুদূষণের সাথে সাথে রাজধানীতে ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে শব্দদূষণও। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা। এভাবে ক্রমাগত শব্দদূষণ বাড়তে থাকলে আগামীতে জাতি একটি অসুস্থ প্রজন্মের জন্ম দেবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের বর্তমান শব্দমান মানুষের স্বাভাবিক শব্দ গ্রহণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু এই দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
শব্দদূষণ কমাতে গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে হাইকোর্টের বিধি-নিষেধ থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। বাংলাদেশে ৯ দশমিক ৬ ভাগ বা দেড় কোটি মানুষ বধিরতার সমস্যায় ভুগছেন। এই বধিরতার অন্যতম কারণ শব্দদূষণ। শব্দদূষণের কারণে বধিরতা ছাড়াও মানুষের আরো নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। মাথাব্যথা, চোখে ব্যথ্যা, শরীরে ঝিম ঝিম ভাব, ক্ষুধামন্দা, হার্টের সমস্যা; এ রকম অনেক সমস্যা হতে পারে শব্দদূষণের কারণে। এ ছাড়া শব্দদূষণের কারণে মেজাজ খিটখিটেও হয়ে যেতে পারে। শব্দদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিশুরা। সরকারি আইন মোতাবেক শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী সব হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতের আশপাশের অন্তত ১০০ মিটারের মধ্যে শব্দদূষণ দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এগুলো কেতাবেই লেখা আছে বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। ৬০ ডেসিবেল শব্দ মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে ফেলতে পারে। সংস্থাটির মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। হাইকোর্ট হাইড্রোলিক হর্নের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু বিআরটিএ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন না। কেননা এখনো রাস্তায় বড় প্রায় সব গাড়িতেই হাড্রোলিক হর্ন রয়েছে। এগুলো দেখার দায়িত্ব বিআরটিএ ও পুলিশের। কিন্তু এগুলো ঠিকমতো দেখভাল হচ্ছে না, আর দেখলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন আছে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই সমস্যার অনেক সমাধান হবে।
ঢাকায় মোট শব্দদূষণের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ দায়ী পরিবহণ। পরিবহণে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে হাইকোর্টের বিধিনিষেধ থাকলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। বিষয়গুলো যাদের দেখার কথা তারা যথাযথভাবে তা দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে শব্দদূষণ নিয়ে আমাদের এত চিন্তা করতে হতো না। জনসচেতনতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। শব্দদূষণ রোধে সরকার কাজ করছে। সরকারের পাশাপাশি দেশের সচেতন লোকজনদেরকেও বায়ু ও শব্দদূষণের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
মন্তব্য