পরিবার- ‘চিরন্তন মাতৃসদন’, ‘শ্বাশত বিদ্যালয়’। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমাজব্যবস্থার এ ‘প্রাণকেন্দ্র’ মানব বিবর্তনের প্রধানতম মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। সভ্য সমাজের ধারণা বলতে গেলে পরিবারপ্রথা থেকেই উদ্ভূত। পরিবারের বসাবসকারি ব্যক্তি স্বভাবতই সভ্য; পরিবার-সমাজের গণ্ডির বাইরের লোকজনকে বলা হয় অসামাজিক, বর্বর। শিক্ষা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সামাজিক-ধর্মীয় রীতিনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে ‘পরিবার’।
সমাজ ব্যবস্থার ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ এই পরিবার প্রথা ভেঙে যাচ্ছে। খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ছে এক একটি পরিবার। এমনকি পরিবারপ্রথা ভেঙে যাবে বলেও শোনা যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা পরিবার প্রথার বিলুপ্তি নিয়ে কথা বলে আসছেন অনেক আগে থেকেই। বাস্তবে ঘটছেও তাই। আর এ প্রবণতার শুরুটাও বেশ পুরোনো। আমরা লক্ষ করেছি, একসময়ের বৃহৎ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে এখন নিতান্তই ক্ষুদ্রকায় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর বিরূপ প্রভাবও পরিলক্ষিত হচ্ছে জোরেশোরেই। যৌথ পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়া একক পরিবারের জীবন সংসার এখন পাখির বাসার মতো। একটি-দুটি ছোট ঘর, ছোট সংসার, ছোট পরিবার; যেখানে বসবাস করে কেবলমাত্র মা-বাবা আর তাদের এক বা দুটি ছেলেমেয়ে। যেখানে নেই তেমন আনন্দ; সবই যন্ত্রের মতো, নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ। পূর্বের সেই যৌথ পরিবারে যারা কর্তা-কর্ত্রীর ভূমিকা পালন করতেন, বর্তমান একক পরিবারে তাদের উপস্থিতি মেহমান হিসেবেই গণ্য করা হয়; ঠিক যেন বাইরের লোক। এসবের ফলে বয়োঃজেষ্ঠ্যদের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ বা সহনশীলতার ঘাটতি পড়ছে। এই ঘাটতির মূলে রয়েছে যৌথ বনাম একক পরিবার।
সময়, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনশীল; প্রকৃতির নিয়মে পরিবর্তিত হয় পারিপাশির্^ক অবস্থাও। এসবের সাথে সঙ্গ মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রকারন্তরে আমরা পরিবার-স্বজন থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। এ প্রবণতা অনাকাঙ্ক্ষিত, অমানবিক, অসামাজিক
দেশের গ্রামাঞ্চলগুলোতে মাত্র ১০ ভাগের কম যৌথ পরিবার টিকে আছে কোনো মতে। আর শহুরে জীবনে যৌথ পরিবার এখন আর চোখেই পড়ে না। ফলে যান্ত্রিক হয়ে গেছে পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধন। উৎসব কিংবা শোক ছাড়া কারো দেখা-সাক্ষাৎও হয় না খুব একটা। আবার দেখা হলেও সেখানে ক্ষণিকের কুশল বিনিময়েই শেষ হয়ে যাচ্ছে সাক্ষাৎ। অথচ অতীতের একান্নবর্তী পরিবারের চিত্র ছিল ভিন্ন, সে যেন এক গল্পকথা। প্রতিটি পরিবার ছিল ভালোবাসার সুতোয় গাঁথা। তবে এগুলো সবই এখন রূপকথা। ধীরে ধীরে যৌথ পরিবারের বটবৃক্ষের ছায়া থেকে অনেক দূরে সরে গেছে পারিবারিক জীবন।
এই সময়ের পরিবারের সন্তানেরা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ানোর অল্পকিছু দিনের মধ্যেই তার শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুইজনের একক পরিবার গড়ে তুলছে; বাদ যাচ্ছে না পরিবারের একমাত্র ছেলেটিও। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে নিজেরা আলাদা থাকতেই আজ তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে পিতামাতর ঠাঁই হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। এছাড়াও বর্তমান সমাজে যে অসহযোগিতার চর্চা দেখা যাচ্ছে তার জন্যও খানিকটা এই একক পরিবারব্যবস্থা দায়ী।
আধুনিক শিক্ষার প্রভাব, নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে এই সামাজিক পরিবর্তনকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি প্রয়োজন। নতুবা মানুষের আন্তরিকতা এবং সম্প্রীতি দিন দিন কমতেই থাকবে। সময়, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনশীল; প্রকৃতির নিয়মে পরিবর্তিত হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থাও। এসবের সাথে সঙ্গ মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রকারন্তরে আমরা পরিবার-স্বজন থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা যেন ‘ অতি আপনজন’ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। এ প্রবণতা অমানবিক, অসামাজিক।
মন্তব্য